বিশ্ববিদ্যালয় পরিক্রমা : ভারতে চলছে লোকসভা নির্বাচন। দেশজুড়ে প্রচার চালাচ্ছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। প্রধানমন্ত্রী পদে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মনোনীত প্রার্থী হলেন নরেন্দ্র মোদি। এরই মধ্যে রাহুল গান্ধীসহ প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের বিরোধিতায় পঞ্চমুখ হয়েছেন তিনি। জবাব দিচ্ছেন রাহুলও, বলছেন দেশের চৌকিদার এখন চোরে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি ভারতীয় ম্যাগাজিন ইন্ডিয়া টুডেকে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। সেই সাক্ষাৎকারে রাহুল বলেছেন, তাঁর লক্ষ্য একটাই। তা হলো মোদি ও বিজেপিকে নির্বাচনে পরাজিত করা। রাহুল বলে দিয়েছেন যে এবারের নির্বাচনে হারতে চলেছে মোদি ও বিজেপি। সাম্প্রদায়িক শক্তির পরাজয়ের বিপরীতে জয়ী হবে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি। রাহুল আরও বলেছেন, ‘আমি মোদিকে ছেড়ে দেব না।’
রাহুল গান্ধীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল মোদি ও বিজেপির নির্বাচনী কৌশল সম্পর্কে। মোদি ও তাঁর দল এখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের ধুয়া তুলেছে। রাহুল বলেন, বর্তমানে ভারত অনেক বড় বড় ইস্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো থেকে নজর ফেরাতেই জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমকে প্রাধান্য দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। রাহুল প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘মোদি কেন তাঁর আমলের রেকর্ড বেকারত্বের হার নিয়ে মুখ খুলছেন না? কৃষকদের গণহারে আত্মহত্যা কি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু নয়? এগুলোই সত্যিকারের জাতীয় ইস্যু। কেন তিনি এসব নিয়ে কথা বলছেন না?’
লোকসভা নির্বাচনের আগ দিয়ে বালাকোটে পাকিস্তানের সীমানার ভেতরে বিমান হামলা চালিয়ে নতুন করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ইস্যুকে জাগিয়ে তুলেছেন নরেন্দ্র মোদি। বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের দাবি, তাদের পুরো শাসনামলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুটি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালানো হয়েছে। এই প্রসঙ্গে রাহুল বলেছেন, ২০১৪ সালের আগে মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় কংগ্রেস সরকার তিনটি সফল সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছিল। কিন্তু তা নিয়ে মোদি সরকারের মতো এত উচ্চবাচ্য করা হয়নি। কারণ, সশস্ত্র বাহিনীর কাজ নিয়ে রাজনীতি করতে চায়নি কংগ্রেস।
মোদি সরকারের কাশ্মীর নীতি নিয়েও সমালোচনা করেছেন রাহুল গান্ধী। সাক্ষাৎকারে এ–সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে রাহুল বলেন, ‘জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে বর্তমান সরকারের কোনো কৌশলই নেই। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর অঞ্চলে উল্টো সমস্যা সৃষ্টি করছেন মোদি। কিন্তু যখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় ছিল তখন কাশ্মীর শান্তিপূর্ণ ছিল।’ রাহুল জানান, এবারের নির্বাচনে জিতলে জম্মু-কাশ্মীরের সমস্যা সমাধানে ঐকান্তিকভাবে কাজ করবেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন রাহুল গান্ধী। ইন্ডিয়া টুডেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাহুল বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদির কোনো পররাষ্ট্রনীতিই নেই। প্রতিদিনের ভিত্তিতে তিনি নীতি নির্ধারণ করেন। তাঁর মনে হলো, হঠাৎ তিনি আফগানিস্তান চলে গেলেন। এরপর হুট করে মনে হলো পাকিস্তান যাওয়ার কথা। তিনি আফগানিস্তান থেকেই পাকিস্তান উড়ে গেলেন। কিন্তু তিনি একবারও ভাবলেন না যে আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান যাওয়ার কারণে আফগান জনগণ নেতিবাচক বার্তা পেতে পারেন। পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কেই তাঁর কোনো জ্ঞান নেই। আসলে তিনি মনে করেন, যত বেশিসংখ্যক বিশ্বনেতাকে জড়িয়ে ধরা যাবে, সেটিই হলো পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা।’
এই জড়িয়ে ধরার প্রসঙ্গ এলেই মনে পড়ে যায় ভারতীয় পার্লামেন্টে নরেন্দ্র মোদিকে রাহুলের আকস্মিকভাবে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য। এই প্রসঙ্গেও মুখ খুলেছেন কংগ্রেস সভাপতি। তাঁর জবানিতে, ‘আমার জড়িয়ে ধরাতে ভালোবাসা ছিল। কিন্তু মোদির জড়িয়ে ধরায় ভালোবাসা নেই, তিনি সুযোগসন্ধানী।’
রাহুল বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে রাফাল চুক্তিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে নতুন করে তদন্ত করা হবে। ভারতে দুর্নীতি কমাতে হলে প্রথমেই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে কয়েকজনের হাতে অনেক ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হয়ে পড়েছে। আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়গুলো নিরীক্ষার আওতায় আনতে হবে এবং বিভিন্ন চুক্তি আরও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।’
কিন্তু এই সবকিছু তখনই ঘটবে যখন কংগ্রেস ক্ষমতায় আসবে। কংগ্রেস কি ক্ষমতায় আসছে? রাহুলের জবাব, ‘আমরা অবধারিতভাবে ক্ষমতায় আসছি।’ তিনি জানান, মোদি এবারের নির্বাচনে জিতছেন না—এটি নিশ্চিত। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট ক্ষমতায় আসছে।
সমালোচকদের অভিযোগ, কংগ্রেস নাকি এবারের লোকসভা নির্বাচনে জেতার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে না। রাহুল গান্ধীর লক্ষ্য নাকি ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন। সাক্ষাৎকারে সেই প্রসঙ্গ উঠতেই অবশ্য সরাসরি তা নাকচ করে দিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই না। এমন কোনো বিষয় নেই। আমরা এবারের নির্বাচনে জিততে চলেছি, বেশ ভালোভাবেই জিতব। নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল বিজেপি স্রেফ ধ্বংস হয়ে যাবে।’
তবে নরেন্দ্র মোদির মতো প্রবল বিরোধীর কাছ থেকেও কিছু বিষয় শিখতে চান রাহুল গান্ধী। তিনি বলেন, ‘কীভাবে একাধিক মানুষকে একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা দেওয়া যায়, সেটি তাঁর কাছ থেকে শেখা যায়। তিনি একজনকে যে কথা বলছেন, পরক্ষণেই আরেকজনকে ঠিক তার উল্টোটা বলে দিচ্ছেন! এটা কীভাবে সম্ভব! এই কাজটিতে একধরনের ছলচাতুরী আছে এবং আমি কখনোই এটা করতে পারি না, পারবও না। তবে একটি বিষয় ঠিক যে, এটি তাঁর এক বিশাল দক্ষতা।’
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোদির বিজেপির জয়রথে পিষ্ট হয়েছিল কংগ্রেস। সেই পরাজয়কে ‘আশীর্বাদ’ বলে মনে করেন রাহুল। তিনি বলেন, ‘এরপরই আমি শিখেছি যে উকে আঘাত কোরো না, আক্রমণ কোরো না। কেউ আক্রমণ করলে উল্টো তাঁকে জড়িয়ে ধরো। যে তোমাকে গালি দিচ্ছে, তাকে শ্রদ্ধা করতে হবে।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে বিজেপির অবিসংবাদিত প্রার্থী হলেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু এর বিপরীতে রাহুল গান্ধীর নাম ততটা শোনা যাচ্ছে না। সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন ওঠে, রাহুল কি প্রধানমন্ত্রী হবেন বা তিনি কি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রস্তুত? জবাবে রাহুল গান্ধী বলেন, ‘আমি এর উত্তর দেওয়ার কে? প্রায় ৯০ কোটি ভোটার ভোট দিচ্ছেন, এটি তাঁদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়। তাঁরা যাকেই বেছে নেবেন, আমি তাতেই সন্তুষ্ট থাকব। আমি মনে করি, তাঁদের সিদ্ধান্তই সঠিক সিদ্ধান্ত। তা সে যে সিদ্ধান্তই হোক না কেন, আমি তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকব।’
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ হারুন-অর-রশিদ
বার্তা সম্পাদকঃ আশিক সরকার
Copyright © 2025 Bporikromanewsbd.com. All rights reserved.