পরিক্রমা ডেস্ক : রাজধানীর উত্তরায় ১৩ নম্বর সেক্টরের কিংফিশার বারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অভিযান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। অভিযানের পর আইনের ধারা অনুযায়ী ডিবি এ অভিযান চালাতে পারে না বলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) মন্তব্য করার পর বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে অভিযোগ উঠেছে, ডিএনসির এক কর্মকর্তাকে হেনস্তারও। যদিও ডিবির পক্ষ থেকে হেনস্তার অভিযোগ অস্বীকার করে বারে অভিযানকে বৈধ বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী লাইসেন্সকৃত বারে এককভাবে অভিযান চালানো কিংবা কাগজপত্র পরীক্ষার এখতিয়ার নেই ডিএনসি ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার। তবে, ডিএনসির অনুমতি ও প্রতিনিধি থাকা সাপেক্ষে আইনানুগ যে কোনো সংস্থা অভিযান পরিচালনা করতে পারবে।
এদিকে, আইন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে হুটহাট ডিবির এ ধরনের অভিযান বার ব্যবসার জন্য হুমকি উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট ও বার মালিক সমিতি। সংগঠনটির নেতারা বলছেন, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, অ্যালকোহলিক বিধিমালা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী চলার পরও যদি কোনো বার কোনো সংস্থার রোষানলে পড়ে, সেটি অবশ্যই দুঃখজনক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিবি দাবি করেছে বারের কাগজপত্র দেখার জন্য তারা অপেক্ষা করেছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী তাদের কাগজপত্র যাচাইয়ের কোনো এখতিয়ার নেই। অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। অথচ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, আপাতত বলবত অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, মাদক আইনের বিধানাবলী প্রাধন্য পাবে। আইনের ১৫, ১৬ ও ১৭ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো অনুমোদিত বার শর্তভঙ্গ করলে ব্যবস্থা নিবে ডিএনসির মহাপরিচালক (ডিজি)।
এছাড়াও অবৈধ মাদক মজুদের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আইনের ২০ ধারায়, ডিএনসির ডিজির অনুমতি নিতে বলা হয়েছে। আইনের ২৩ ধারায় পুলিশসহ অন্য সংস্থাগুলোকে মাদক নির্মূলে যে কোনো জায়গায় অভিযান পরিচালনার কথা বলা হয়েছে, সেখানেও লাইসেন্সপ্রাপ্ত জায়গা ব্যতীত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালের ১৮ মার্চ
জুরাইনের আইরিস পাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে র্যাব ও কাস্টমস যৌথভাবে রেইড দিয়ে তল্লাশি চালায়। এই রেইড চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতে তারা একটি রিট মামলা করেন। ওই মামলায় তারা দাবি করেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ ধারা লঙ্ঘন করে তাদের রেস্টুরেন্টে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এরপর উচ্চ আদালত ওই অভিযানকে অবৈধ ঘোষণা করে নির্দেশনাও দেন।
এদিকে, গত বৃহস্পতিবার রাতে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গরিবে নেওয়াজ অ্যাভিনিউয়ের ‘লেক ভিউ রেস্টুরেন্ট ও বার’-এ অভিযানের সময় পুলিশ ওই বারের নাম জানায় ‘কিংফিশার।’ তবে কাগজপত্রে দেখা গেছে, সেটি একটি রেস্টুরেন্ট ও বার। যার নাম ‘লেকভিউ রেস্টুরেন্ট ও বার’। ডিএনসি থেকে ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি বার পরিচালনার লাইসেন্স পায়। ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার অনুমোদন নেয়া আছে। মালিক মুক্তার হোসেন।
ডিএনসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বারের অনুমোদন বা লাইসেন্স ডিএনসি দেয়, তারাই এর দেখভাল করে। বারে কোনো সংস্থা বা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই ডিএনসি ডিজির প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাখতে হবে। তবে উত্তরায় ডিবির ওই অভিযানে ডিএনসির কাউকে জানায়নি পুলিশ। মহাপরিচালকের কোনো প্রতিনিধিও ছিলেন না। উল্টো অভিযানের বিষয়ে খবর পেয়ে অফিসের নির্দেশে সেখানে যান ডিএনসির উত্তরা এলাকার পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান। তিনি অভিযোগ করেন, তাকে ডিবি পুলিশ একটি কক্ষে আটকে রেখে অপেশাদার আচরণ করে। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। পাশাপাশি পুলিশের এমন আচরণে সংস্থাটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ডিএনসি কর্মকর্তারা আরো বলেন, স্থানীয় মাস্তান, বিভিন্ন সংস্থার চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে ২০১৮ সালে রেস্টুরেন্ট ও বার মালিকরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর ডিএনসির তৎকালীন ডিজি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের আলোকে ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর একটি সার্কুলার জারি করেন। সেই সার্কুলারও অমান্য করা হয়েছে।
পুলিশ ছাড়াও প্রায়ই আরো চারটি সংস্থা দেশের অনুমোদিত বারে হুটহাট অভিযান পরিচালনা করার নামে হয়রানি করে বলেও অভিযোগ উঠেছে। কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলেও এসব সংস্থা বিভিন্ন অজুহাতে ভয়ভীতি দেখায়। ডিএনসি জানিয়েছে, সারাদেশে ১৮৯টি রেস্টুরেন্ট ও বার রয়েছে। এগুলো লাইসেন্স দেয়া, নবায়ন ও মজুত দেখভাল করে এই সংস্থাটি। বারে মদপানের অনুমতিও দিয়ে থাকে অধিদপ্তর। তবে অভিযোগ রয়েছে বারগুলোতে মদপানের লাইসেন্স ছাড়া লোকজন বেশি যাওয়া-আসা করে। এসব ফাঁক-ফোকরের কারণেই বিভিন্ন সংস্থা চাঁদাবাজির সুযোগ পায়। নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে থাকে।
লেকভিউ রেস্টুরেন্ট ও বারের মালিক মুক্তার হোসেন জানান, কোনো ত্রুটি থাকলে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। কিন্তু যদি এভাবে বারে ঢুকে সবাইকে বেধে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে আমরা ব্যবসা করবো কীভাবে?
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট ও বার মালিক সমিতির যুগ্ম-আহ্বায়ক জাহিদ আজাদ শ্যামল বলেন, কোন আইনে ডিবি উত্তরার বারটিতে অভিযান চালিয়েছে সেটি আমি জানি না। মাদক আইনটা আমরা জানি। সে অনুযায়ী ব্যবসা করি। এর বাইরে অ্যালকোহলিক বিধিমালা অনুযায়ী বারের কার্যক্রম পরিচালনা করে সবাই। এরপরও ডিবি পুলিশের এ ধরনের অভিযান ও মামলা দায়েরের ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা সব বারের মালিকরা মিটিং করে একটি সিদ্ধান্ত নেব। এরপর পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে করে জানানো হবে। তিনি আরো বলেন, আমরা সরকারকে রাজস্ব দেই। তারপরও আমাদের বিভিন্নভাবে হেয় করা হয়, যা কাক্সিক্ষত নয়। আমরা সমস্যা ও সংকট নিয়ে নিজেরা আলোচনা করব। পাশাপাশি সব বার ও রেস্টুরেন্টগুলোকে একটি ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করছি।
সম্প্রতি ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিবির প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, পুলিশ যে কোনো অন্যায় ও অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারাদেশের যে কোনো সময় অভিযান চালাতে পারে। সুতরাং নিয়ম মেনেই রাজধানীর উত্তরার কিংফিশার বারে অভিযান চালানো হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে- কারা অভিযান পরিচালনা করবেন আর কারা করতে পারবে না। সুতরাং কোথায় কোথায় অবৈধ ডিজে পার্টি ও মদ বিক্রি হয় তথ্য পেলে আমরা অবশ্যই সেখানে অভিযান পরিচালনা করব। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ও পুলিশ আলাদা সংস্থা হলেও একে অন্যের সহযোগী বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গরীবে নেওয়াজ অ্যাভিনিউ রোডের লেকভিউ রেস্তোরাঁয় অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। অভিযানে ৫০০ বোতল দামি বিদেশি মদ এবং প্রায় ছয় হাজার ক্যান বিয়ার জব্দ করা হয়। ৩৫ জনকে গ্রেপ্তারের পর উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা দায়ের করে ডিবি পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে বারটির ম্যানেজার আবু সালেহ’র ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম নিভানা খায়ের জেসীর আদালত এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এছাড়া এ মামলার বাকি ৩৪ আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ হারুন-অর-রশিদ
বার্তা সম্পাদকঃ আশিক সরকার
Copyright © 2025 Bporikromanewsbd.com. All rights reserved.