পরিক্রমা ডেস্ক : তিনিই নেতা যিনি তার অনুসারীদের স্বপ্ন দেখাতে পারেন। তিনিই নেতা যিনি তার নেতৃত্বের সুবাতাস তার সহনেতা ও কর্মীদের মাঝে বিলিয়ে দিতে পারেন। তিনিই নেতা যিনি জনমনে দুঃসময়েও আশার সঞ্চার করতে পারেন। তিনিই নেতা যিনি জাতিকে তার স্বপ্নের সমান হতে নিরন্তর সমাজকে সচেষ্ট রাখতে পারেন। এমন নান্দনিক নেতার সন্ধান আমরা পেয়েছিলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মাঝে। এই নেতৃত্ব আমাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে সমৃদ্ধির পথরেখায় স্বদেশকে টেনে তুলে এনেছিলেন। নেতৃত্বের সেই আভা পুরো জাতির মননে লেগেছিল বলেই লড়াকু বাংলাদেশ শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল বিরাট আস্থার সঙ্গে। বিশ্বাসঘাতকরা হস্তক্ষেপ না করলে সেই সুমহান নেতৃত্বের বলেই বাংলাদেশ আরও বহু আগেই পৌঁছে যেত সমৃদ্ধির কাক্সিক্ষত সোপানে।
বাঙালি জাতির বড়ই সৌভাগ্য যে, পঁচাত্তর-পরবর্তী অনেকগুলো বছর অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকা বাংলাদেশ ফের গতিময় সম্মুখপানে হাঁটতে থাকে বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে। শত সংকট মোকাবিলা করেই পথের বাধা দুহাতে সরিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ। বিশ্বামানের মিডিয়া, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনসহ অনেকেই এখন বাংলাদেশের এই এগিয়ে চলার ভঙ্গিটির প্রশংসা করছেন। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তিনি বলে গেলেন যে, অপ্রতিরোধ্য গতিময় বাংলাদেশের এই সাফল্যগাথা অন্যান্য দেশকে জানাতে চায় বিশ্বব্যাংক। এই কথাগুলো এমন এক সময়ে শোনা যাচ্ছে যখন সারাবিশ্ব এক মহামন্দা দিকে ধাবিত হচ্ছে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের অশনিসংকেত বেজে উঠেছে। ২০২৩ সালে দশমিক চার শতাংশ হারে সারাবিশ্বর প্রবৃদ্ধি কমে যাবে বলে বিশ্বব্যাংক হালে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে। অথচ এডিবি বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭.৩ শতাংশ। চলতি বছরে তা হবে ৬.৯ শতাংশ। শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এই হার হয়তো পুরোপুরি অর্জিত নাও হতে পারে। তা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত কোভিডকালের মতো পৃথিবীর অন্যতম সেরা গতিময় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ঠিকই তার সুনাম ধরে রাখতে পারবে বলে প্রত্যাশা করছি।
কোন শক্তিবলে বাংলাদেশ এই সফলতা দেখিয়ে চলেছে? অবশ্য দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের বড় অবদান রয়েছে এই গতিময়তার পেছনে। আছে মানুষের ওপর বিপুল বিনিয়োগের জোর। আমরা ২০০৯ সালের পর এই নেতৃত্বের জোরেই সেই সময়ের বিশ^ আর্থিক সংকট দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করে দেশকে এক নয়া উচ্চতায় নিতে পেরেছিলাম। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের যে কৌশল প্রধানমন্ত্রী সে সময় সূচনা করেছিলেন তার ধারাবাহিকতায় চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটেও বাংলাদেশ অনেক দেশের চেয়ে ভালো করবে বলে আশা করা যায়। প্রধানমন্ত্রীর এবারের জন্মদিনে আমরা সেই সুদূরপ্রসারী সবার জন্য উন্নয়নের কৌশলটি বোঝার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি উন্নয়ন কৌশলের মূল চালকগুলোর মধ্যে সবার আগে কৃষির কথা এসে যায়। কৃষিই আমাদেরর রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে চলেছে। কৃষি শুধু খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের বড় অংশ নিশ্চিত করছে তাই নয়, আমাদের শিল্পপণ্যের চাহিদাসহ অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও ভোগও নিশ্চিত করছে। আমাদের গতিময় প্রবৃদ্ধির ৭৩ শতাংশের উৎস হচ্ছে এই অভ্যন্তরীণ ভোগ ও চাহিদা। কৃষির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে লাখ লাখ ছোট ব্যবসায়ী ও অকৃষি খাতের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও। ক্ষুদ্রঋণ ছাড়াও ব্যাংকগুলো কৃষি ও অকৃষির জন্য সিএসএমই ঋণ, মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা এবং ডিজিটাল অর্থায়নের মতো নানা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের গ্রামীণ অবকাঠামো, সামাজিক সুরক্ষা এবং নানামাত্রিক ডিজিটাল সেবার পাশাপাশি ব্যক্তি খাতও এগিয়ে এসেছে অন্তর্ভুক্তিমূলক এই উন্নয়নের ধারাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের নেতৃত্বে যখন বঙ্গবন্ধু আসীন হন তখনো দেশের অর্থনীতি ছিল খুবই দুর্বল। মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলার ছিল সম্বল। মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯৩ ডলার। আর দারিদ্র্যের কলেবরটা ছিল অনেক বড়। ৮০% মানুষ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। কিন্তু সেই সময় তিনি শিল্প খাতের পুনরুজ্জীবন, কৃষির আধুনিকীকরণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রাথমিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি- এসব বিষয়ে খুবই বিচক্ষণ নীতি-কৌশল অবলম্বন করেন। সেই ধারাবাহিকতায় তিনি সফলও হন। আমরা তাই দেখতে পাই ১৯৭৫ সালে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ২৭৩ ডলারে উন্নীত হয়। মূলত বিশ্বকে সংকটের কারণে বেড়ে যাওয়া মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসে। ক্ষুধার্তদের জন্য একটি সমন্বিত রেশনিং ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। আর এভাবেই আমাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার থেকে সমৃদ্ধির দিকে যাত্রা শুরু করে। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। চক্রান্তকারীরা ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়। সে সময় আমরা দেখতে পাই মাথাপিছু আয় দ্রুতই কমতে থাকে। আর তাই বঙ্গবন্ধু যেখানে সর্বশেষ মাথাপিছু আয় রেখে গিয়েছিল সেখানে ফিরে আসতে ১৩ বছর সময় লেগে যায়। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ পালাবদলের কথা কারও অজানা নয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন পাহাড়সম দুঃখ নিয়ে। এর পর নানান রাজনৈতিক জটিলতা মাড়িয়ে তাকে পথ চলতে হয়। কখনো কখনো তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়। ’৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি সরকার গঠন করেন। এ সময় থেকেই আমরা দেখি তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের যাত্রা ফের শুরু করেন। অনেকেরই হয়তো মনে আছে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসীন হওয়ার দুবছরের মধ্যেই সর্বনাশা বন্যার কবলে পড়ে বাংলাদেশ। কিন্তু বন্যা মোকাবিলায় তিনি যোগ্য মানবিক নেতৃত্বের পরিচয় দেন।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শেখ হাসিনা পিতার পথ অনুসরণ করেই কৃষি ও কৃষকের উন্নতিতে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হন। কৃষির আধুনিকীকরণের প্রত্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পায়ন ও জনগণের সেবামূলক খাতকে অর্থবহ এবং জনগণের কাছে নিয়ে যেতে বেশি করে অর্থ বরাদ্দ দিতে থাকেন। এখানেই শেষ নয়- তার গণমুখী উন্নয়ন কৌশলের আওতায় দেশের বঞ্চিত শ্রেণির জন্য বিভিন্ন ধরনের ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। সামাজিক সুরক্ষার বলয়কে আরও বিস্তৃত করেন। ২০০১ সালে নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে আমরা দেখতে পাই শেখ হাসিনার নেওয়া জনমুখী অনেক উদ্যোগেরই ঠিক উল্টোযাত্রা। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার আত্মপ্রত্যয়ী এক স্লোগান দিয়ে তিনি আবার জনগণের উন্নয়নের স্টিয়ারিং ধরেন। এখানেও আমরা দেখতে পাই তিনি উন্নয়নের নতুন কৌশল সাজিয়েছেন যেখানে অন্তর্ভুক্তি উন্নয়নের লক্ষ্য আরও বেশি গোছানো, আরও বেশি দৃশ্যমান, আরও বেশি স্বপ্নময়। বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র, বহুমুখী সড়ক, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টাওয়ার, অর্থনৈতিক অঞ্চল, বঙ্গবন্ধু শিল্পপার্ক, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, এক্সপ্রেসওয়ে- এ রকম আরও মেগা প্রকল্প হাতে নেন। এর সুফল মানুষ পেতে শুরু করেছে। পদ্মা সেতু খুলে দেওয়া হয়েছে ২৫ জুন থেকে। অন্যান্য মেগা প্রকল্পগুলো চালু হলে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে এতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের ২০ বছর মেয়াদি দ্বিতীয় প্রেক্ষিত- পরিকল্পনার রপকল্প ২০৪১ তার নেতৃত্বে প্রণয়ন করা হয়েছে। তিনি আরও হাতে নিয়েছিলেন একুশশ সাল নাগাদ পরিবশবান্ধব বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা।
নেতৃত্বের গুণে শেখ হাসিনা বিশ^ব্যাপী আজ ‘রোল মডেল’। জাতিসংঘ থেকে পেয়েছেন ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’। আবার বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার দেয় গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনাইজেশন। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি তাকে পুরস্কৃত করেছে ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ’ হিসেবে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের জন্যও তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন। পেয়েছেন গান্ধী পুরস্কার। বিশ^ভারতীয় বিশ^বিদ্যালয় দিয়েছে তাকে দেশকোত্তর পুরস্কার।
আমরা দেখছি এতদঞ্চলে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ শেখ হাসিনা মোকাবিলা করছেন যথেষ্ট দৃঢ়তার সঙ্গে। মিয়ানমার থেকে আগত বারো লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন নিজ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর নানান চাহিদার চাপ থাকা সত্ত্বেও। এ কারণেই তিনি ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে খ্যাত হয়েছেন। বৈশ্বিক নানান অবস্থার মধ্য দিয়েও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তিনি ভালো ও নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। খোলা মনে আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে কানেক্টিভিটি প্রসার ঘটিয়ে তিনি বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও গতি আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার বাংলাদেশও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশের দুঃখী মানুষের পক্ষে তিনি বিশ্বব্যাপী জলবায়ু কূটনীতি পরিচালনা করে চলেছেন নিরন্তর।
সবশেষে বলব, বাংলাদেশকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিনিয়তই তিনি বলেন, ‘আমরা দেশ উন্নয়নের যে গতিধারা সৃষ্টি করেছি তা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব মানচিত্রে অচিরেই উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।’ আসলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মমর্যাদাশীল ‘সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার লড়াইটা হৃদয় নিঙরে করছেন। নিঃসন্দেহে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সহিংসতা ও জবাবদিহিতার অভাবের মতো সমস্যাগুলো মোকাবিলা করেই তাকে এগোতে হচ্ছে। সমাজে এবং রাজনীতিতে শান্তি ও সুস্থিরতা বজায় রাখা শুধু তার একার কাজ নয়। পুরো সমাজকেই সচেষ্ট থাকতে হবে সামাজিক ও রাজনৈতিক শান্তির অন্বেষায়। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৬তম জন্মদিন। দূরদর্শী এই রাষ্ট্রনায়ককে স্যালুট জানিয়ে বলব- ‘শুভ জন্মদিন’।
ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ হারুন-অর-রশিদ
বার্তা সম্পাদকঃ আশিক সরকার
Copyright © 2025 Bporikromanewsbd.com. All rights reserved.