বিশ্ববিদ্যালয় পরিক্রমা ডেস্ক : ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ বিপ্লব দিবস পালন করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। দিবসটি উপলক্ষে ডাকা সমাবেশে বিপ্লব দিবসের মাহাত্ম্যের ব্যাখ্যাও দেন তৎকালীন ছাত্রনেতারা। তারা বলেন, এই সেদিন (একাত্তরের ৩ মার্চ) যেদিন বঙ্গবন্ধু তাঁর অনুপস্থিতিতে আন্দোলন চালানোর রূপরেখা দিয়েছিলেন। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘বাংলার মানুষ খাজনা দেয়, ট্যাক্স দেয় রাষ্ট্র চালানোর জন্য, গুলি খাওয়ার জন্য নয়।’ ১৯৭২ সালের এই সময়ে রাশিয়া সফরে থাকাকালে একের পর এক সভায় অংশ নেন বঙ্গবন্ধু। দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তাদের বক্তৃতায় দুই দেশের সম্পর্কের মূলনীতি ঘোষণা করেছিলেন।
এই দিনে বিপ্লব দিবস
১৯৭২ সালের এই দিনে সে সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা শাহজাহান সিরাজ জনসভায় বিপ্লব দিবসের মাহাত্ম্য নিয়ে কথা বলেন। শাহজাহান সিরাজ বলেন, ‘১৯৭১ সালের তেসরা মার্চ সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়।’ পূর্বে যেসব শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক দীর্ঘ ছুটি দিয়েছেন, তাদের পুনর্বহালের তীব্র বিরোধিতা করেন তিনি।
শাহজাহান সিরাজ বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। জনগণের মুক্তি না আসা পর্যন্ত ছাত্রলীগ সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।’ তিনি সরকারের কাছে বর্ণচোরাদের শাস্তি দাবি করেন।
একাত্তরের ৩ মার্চ যা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু এদিন তাঁর অনুপস্থিতিতে আন্দোলন চালানোর রূপরেখা দেন। তিনি তাঁর অনুপস্থিতিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান করেন। তিনি বলেন, ‘হয়তো এটাই আপনাদের সামনে আমার শেষ ভাষণ। আগামী রবিবার (৭ মার্চ) রেসকোর্সে আমার বক্তৃতা করার কথা। কিন্তু কে জানে, সেই সুযোগ আমাকে নাও দেওয়া হতে পারে। তাই আজ আপনাদের কাছে আর আপনাদের মাধ্যমে বাংলার জনগণের কাছে আমি বলে যাই— আমি যদি নাও থাকি আন্দোলন যেন না থামে।’
বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘বাংলার ভাইয়েরা আমার— আমি বলছি, আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন না থামে, বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি যদি নাও থাকি, আমার সহকর্মীরা আছেন। তারাই নেতৃত্ব দেবেন। আর যদি কেউই না থাকে, তবু আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালিকে নেতা হয়ে নির্ভয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। যে কোনও মূল্যে বাংলার স্বাধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে।’
সরকারের সমালোচনাও করবে ছাত্রলীগ
১৯৭২ সালে ছাত্রলীগ সেই বিপ্লব দিবসে ঘোষণা দেয়— শুধু সরকারকে সমর্থন নয়, সমালোচনাও করবে ছাত্রলীগ। শুধু সরকারকে সহযোগিতা আর সমর্থন দিয়ে যাবে না। প্রয়োজনবোধে যেকোনও গঠনমূলক সমালোচনা করা যাবে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা করেন। ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব তরুণদের বাঙালি সংস্কৃতি অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়ে ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশে কোনও উর্দু বা হিন্দি ছবি চলতে পারবে না।’ বাজারে কুৎসিত তথ্য সরবরাহ বন্ধ করার জন্য তিনি প্রকাশক ও বিক্রেতাদের সতর্ক করে দেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘যদি এই সপ্তাহের মধ্যে এগুলো করা না হয়, তবে ছাত্রলীগ কর্মীরা ৮ মার্চ থেকে পিকেটিং শুরু করবে।’
এশিয়ায় শান্তি কামনা
বাংলাদেশ ও রাশিয়ার দুই রাষ্ট্রপ্রধান তাদের বক্তৃতায় দুই দেশের সম্পর্কের মূলনীতি ঘোষণা করেন। পরস্পরের সম-মর্যাদায় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান এবং কারও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা হবে এই সম্পর্কের ভিত্তি। দুই দেশের পররাষ্ট্র নীতি শুধু উপমহাদেশকেই সুরক্ষিত নয়, বিশ্বব্যাপী এর পরিব্যাপ্ত সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়। সদ্য স্বাধীনতা লাভকারী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব দেশ গড়ার মাধ্যমে এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। নিজের দেশের অসংখ্য সমস্যার মধ্যে থেকেও তিনি ভিয়েতনামের ট্র্যাজেডি ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি উদাসীন থাকতে পারেননি। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছেন ভিয়েতনাম থেকে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার না হলে শুধু এশিয়া নয়, বিশ্ব শান্তি আসবে না।
লেলিনগ্রাদে বঙ্গবন্ধু
মস্কো থেকে এদিন বঙ্গবন্ধু লেলিনগ্রাদে পৌঁছান। প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন তার সঙ্গে ছিলেন। তার আগমনকে কেন্দ্র করে লেলিনগ্রাদ বিমানবন্দরটি বাংলাদেশ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রুশ ফেডারেশনের পতাকায দিয়ে সাজানো হয়। লেলিনগ্রাদে বঙ্গবন্ধুকে সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলেকজান্ডার আন্তরিক সংবর্ধনা জানান।
নিকোলাই পদগর্নির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু
সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সুপ্রিম সোভিয়েত প্রেসিডিয়ামের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই ভি পদগর্নি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানান। এই সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, পররাষ্ট্র সচিব এস এ করিম এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামসুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে পদগনি বাংলাদেশের জনগণের নতুন জীবন গঠনে অধিকতর সাফল্য কামনা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সোভিয়েত সরকার ও জনগণ যে সহায়তা করেছে, সেজন্য বঙ্গবন্ধুও গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তারপর ঋদ্ধতা ও বন্ধুত্বের পরিবেশে তারা দুই দেশের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতাকে আরও বিকশিত ও জোরদার করাসহ আন্তর্জাতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন।
এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের বেশ কিছু এলাকার মানুষের তখন নাভিশ্বাস দশা। ময়মনসিংহে চালের দাম প্রতিমণ ৬০ টাকা— যা কোনও কোনও মানুষের মাসিক আয়ের কাছাকাছি। এ নিয়ে ৪ মার্চ দৈনিক বাংলা পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি কার্টুন ও সংবাদ প্রকাশ করা হয়।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ হারুন-অর-রশিদ
বার্তা সম্পাদকঃ আশিক সরকার
Copyright © 2025 Bporikromanewsbd.com. All rights reserved.