বিশ্ববিদ্যায়ল পরিক্রমা ডেস্ক : বাংলাদেশের ইতিহাসে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একেবারেই ভিন্নমাত্র এনেছে। দীর্ঘদিন পর সব দল আগামী রোববারের এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
বিশ্লেষকদের ভাষ্যে, এই নির্বাচন রাজনৈতিক ইতিহাসের বাঁক বদলে দেবে। পাল্টে দেবে স্বাধীন বাংলাদেশের গতিপথ। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জিতলে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা চারবারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে রেকর্ড গড়বেন।
টানা ১০ বছর ক্ষমতাসীন হওয়ার ফলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত হয়েছে। তবে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও, যেটি মনোনয়ন থেকে নির্বাচনী প্রচারণাতেও স্পষ্ট হয়েছে।
বিপরীতে টানা এক দশক ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচন ঘিরে একেবারেই ভিন্ন মেজাজে হাজির হয়েছে। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজা মাথায় নিয়ে কারাগারে। তাকে ছাড়াই এই প্রথম তারা কোনো জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
ঐক্যফ্রন্টের ভাষ্যে, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের ‘চরম বিমাতাসূলভ’ আচরণের পরেও তারা জনগণের অধিকার আদায়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে লড়ছেন। প্রবীণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন এই জোটের প্রধান হওয়ায় ভঙ্গুর ইমেজ কাটিয়ে বিএনপিও শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
এজন্য এবারের ভোট হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। যদিও জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আন্তর্জাতিক মহলের পক্ষ থেকে ভোটে সহিংসতার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
ইতিহাসের এমন বাঁক বদলের নির্বাচন আয়োজনে সকল প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইতোমধ্যে নির্বাচনী সরঞ্জাম মাঠপর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ভোটের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখতে মাঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
শুক্রবার বিকেলে ভোটের মাঠ সাজানোর বিস্তারিত সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তুলে ধরেন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।
একই সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার প্রক্রিয়ার বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘প্রতিটি ভোট কেন্দ্রেই ফলাফল ঘোষণা হবে। প্রিজাইডিং অফিসার ভোটগ্রহণ শেষে সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে কেন্দ্রেই ভোট গণনা করবেন। এ সময় সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও প্রার্থীর এজেন্টরা উপস্থিত থাকতে পারবেন। ভোট গণনা শেষে প্রিজাইডিং অফিসার লিখিত ফলাফল সংশ্লিষ্টদের সরবাহর করবেন। পরে এ ফলাফল রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠাবেন। রিটার্নিং অফিসাররা তা ইসিতে পাঠাবেন। ইসির ফোয়ারা প্রাঙ্গণে স্থাপিত মঞ্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করা হবে। এ চত্বরে ইসি ১০টি মনিটরের মাধ্যমে ফলাফল প্রদর্শন করবে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইভিএমের ভোট কেন্দ্রে স্মার্টকার্ড বাধ্যতামূলক নয়। তবে নিয়ে গেলে ভোটদান সহজ হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন বলেন, ‘সারা দেশে ভোট কেন্দ্রের জন্য এসএমএসের মাধ্যমে ভোটার এলাকা, ভোটার কেন্দ্র ও কেন্দ্রের নম্বর পাওয়া যাবে। শনিবার থেকে এই সেবা চালু হবে।’
তিনি জানান, পোলিং অফিসাররা সকাল ৮টার আগেই প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে নিয়োগপত্র দেখাবেন। এসব বিষয়ে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে ইসি ব্যবস্থা নেবে।
শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে সব ধরনের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা বন্ধ হয়েছে। এখন অপেক্ষা শুধু ভোটের। আগামী রোববার সকাল ৮টা থেকে একটানা বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ করা হবে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। ফলে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী বিজয়ী হন। কাজের কাজ যেটি হয়, দেশের অর্ধেক মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হন।
এবার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধনে থাকা সব দল অংশগ্রহণ করছে এবং ৩০০ আসনের প্রত্যেকটিতে একাধিক প্রার্থী রয়েছে। যার ফলে দেশের সব মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাচ্ছেন।
এই ভোট ঘিরে আগামীকাল শনিবার মধ্যরাত (রাত ১২টা) থেকে ভোটের দিন দিনগত মধ্যরাত (রাত ১২টা) পর্যন্ত বেবিট্যাক্সি/অটোরিকশা/ইজিবাইক, ট্যাক্সি ক্যাব, মাইক্রোবাস, জিপ, পিক-আপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পোসহ স্থানীয় যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। একই নিষেধাজ্ঞা রয়েছে নৌযান চলাচলে।
এ ছাড়া ভোট সামনে রেখে শুক্রবার দিনগত মধ্যরাত (রাত ১২টা) থেকে ১ জানুয়ারি দিনগত মধ্যরাত (রাত ১২টা) পর্যন্ত মোট চার দিন সারা দেশে মোটরসাইকেল চালানোয় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে ইসির স্টিকার লাগানো মোটরসাইকেল এই নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে।
যান চলাচলের নিষেধাজ্ঞার সময় রিটার্রিং কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের নির্বাচনী এজেন্ট, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা (পরিচয়পত্র থাকতে হবে) চলাচল করতে পারবেন। তাছাড়া নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত সাংবাদিক (পরিচয়পত্র থাকতে হবে), নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, নির্বাচনের বৈধ পরিদর্শক ও কতিপয় জরুরি সেবা যেমন: অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ডাক, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদির কাজে নিয়োজিত যানবাহনে নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।
এ ছাড়া মহাসড়ক, বন্দর ও জরুরি প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন বলে নির্দেশনা দিয়েছে ইসি।
আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবন চত্বরে ফলাফল ঘোষণার স্থান পরিদর্শনে এসে শুক্রবার দুপুরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। ভোট উৎসবমুখর হবে।
তিনি বলেন, ‘ব্যাপক সংখ্যক ও সর্বাধিক প্রার্থী এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। উৎসবমুখর ভোট হবে এটাই আশা। আমরা প্রস্তুত, ভোটাররা সবাই উৎসবমুখর এবং আনন্দঘন পরিবেশে ভোটে অংশগ্রহণ করবেন।’
সিইসি আরও বলেন, ‘সবাই যাতে করে ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি যেতে পারেন। সকলের জন্য নিরাপত্তা, সকলের জন্য নিরাপদ অবস্থান সৃষ্টি করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনুরোধ করব।’
ইসি সচিব জানান, এবার ২৯৯ আসনে ভোটগ্রহণ করা হবে। গাইবান্ধা-৩ আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে, সেখানে ভোট হবে আগামী ২৭ জানুয়ারি। ২৯৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৮৬১জন। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ১ হাজার ৭৩৩ জন এবং স্বতন্ত্র ১২৮ জন।
তিনি জানান, ভোটে রিটার্নিং অফিসার ৬৬ জন। এদের মধ্যে দু’জন বিভাগীয় কমিশনার ও ৬৪ জন জেলা প্রশাসক। ৪০ হাজার ১৮৩টি ভোট কেন্দ্রের ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২টি ভোটকক্ষে ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। এবার পুরুষ ভোটার ৫ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫ জন এবং মহিলা ভোটার রয়েছেন ৫ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২ জন।
ভোট কেন্দ্র ও নির্বাচনী এলাকায় সেনাবাহিনী ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ ৮ হাজার। এর মধ্যে পুলিশ প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার, আনসার প্রায় ৪ লাখ ৪৬ হাজার, গ্রাম পুলিশ প্রায় ৪১ হাজার। সেনা বাহিনী (প্রতি প্লাটুনে ৩০জন) ৩৮৯টি উপজেলায় ৪১৪ প্লাটুন, নৌবাহিনী ১৮টি উপজেলায় ৪৮ প্লাটুন, কোস্টগার্ড (প্রতি প্লাটুনে ৩০জন) ১২টি উপজেলায় ৪২ প্লাটুন, বিজিবি (প্রতি প্লাটুনে ৩০জন) ৯৮৩ প্লাটুন,
র্যাব (প্রতি প্লাটুনে ৩০জন) প্রায় ৬০০ প্লাটুন ভোটের মাঠে নিয়োজিত থাকবে।
এ ছাড়া মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের সংখ্যা (র্যাবসহ) প্রায় ২ হাজার প্লাটুন (প্রায় ৬৫ হাজার)। সারা দেশে জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশের টহল দল নিয়োজিত আছে। ভোটের দায়িত্বে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাচনী কর্মকর্তা
১ হাজার ৩২৮ জন।
ইসি জানায়, দেশি ৮১টি পর্যবেক্ষক সংস্থার ২৫ হাজার ৯০০,
ফেম্বোসা, এএইএ, ওআইসি ও কমনওয়েলথ থেকে আমন্ত্রিত ও অন্যান্য বিদেশি পর্যবেক্ষক ৩৮ জন,
কূটনৈতিক/বিদেশি মিশনের কর্মকর্তা ৬৪ জন এবং বাংলাদেশস্থ দূতাবাস/হাইকমিশন বা বিদেশি সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি ৬১ জন থাকবেন।
৬ আসনে ইভিএম
নানা আলোচনা-সমালোচনা শেষে এবার ৬টি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এগুলো হলো—
ঢাকা-৬: প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ৮ জন। মোট ভোটার ২ লাখ ৬৯ হাজার ৩১৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৪৩ হাজার ১০৭ জন। নারী ভোটার ১ লাখ ২৬ হাজার ২০৮ জন। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৯৮টি এবং ভোট কক্ষের সংখ্যা ৬৩৮টি।
ঢাকা-১৩: প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ১০ জন। মোট ভোটার ৩ লাখ ৭২ হাজার ৭৭৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৯২ হাজার ৬০৭ জন। নারী ভোটার ১ লাখ ৮০ হাজার ১৬৮জন। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৪টি এবং ভোট কক্ষের সংখ্যা ৮৭০টি।
রংপুর-৩: প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ৯ জন। মোট ভোটার ৪ লাখ ৪১ হাজার ৬৭১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ২১ হাজার ১০৯ জন। নারী ভোটার ২ লাখ ২০ হাজার ৫৬২ জন। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১৭৫টি এবং ভোট কক্ষের সংখ্যা ১ হাজার ২৩টি।
খুলনা-২: প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ৭ জন। মোট ভোটার ২ লাখ ৯৪ হাজার ১১৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৪৫ জন। নারী ভোটার ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৭১ জন। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১৫৭টি এবং ভোট কক্ষের সংখ্যা ৭২০টি।
সাতক্ষীরা-২: প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ৬ জন। মোট ভোটার ৩ লাখ ৫৬ হাজার ২৪৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭৭ হাজার ২৭৮ জন। নারী ভোটার ১ লাখ ৭৮ হাজার ৯৬৮ জন। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৭টি এবং ভোট কক্ষের সংখ্যা ৮৭৪টি।
চট্টগ্রাম-৯: প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ৮ জন। মোট ভোটার ৩ লাখ ৯০ হাজার ৪৩১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৪ হাজার ২০৬ জন। নারী ভোটার ১ লাখ ৮৬ হাজার ২২৫ জন। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১৪০টি এবং ভোট কক্ষের সংখ্যা ৯২০টি।