Home ক্যাম্পাস খবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোগ্রাম পরিচালকের ভুতুড়ে বিল নিয়ে হইচই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোগ্রাম পরিচালকের ভুতুড়ে বিল নিয়ে হইচই


বিশ্ববিদ্যালয় পরিক্রমা ডেস্ক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগে দুই বছর মেয়াদি একটি প্রোগ্রাম চালু করেছে; যার নাম মাস্টার্স অব অ্যাকাউন্টিং ইন ট্যাক্সেস (ম্যাট)। এ প্রোগ্রামের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। যিনি কোনো নিয়মনীতি অনুসরণ না করে অননুমোদিত অসংখ্য খাতে ব্যয় দেখিয়ে ‘ভুতুড়ে’ বিল দিয়েছেন প্রায় কয়েক লাখ টাকার।

ফলে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রিয়াজুর রহমান চৌধুরী বেশ কিছু বিলে স্বাক্ষর করেননি; যা নিয়ে বিভাগে হইচই পড়ে গেছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত বিভাগের সর্বোচ্চ ফোরাম অ্যাকাডেমিক কমিটির (এসি) সভায় অ্যাজেন্ডাভুক্ত আলোচনা হয়। ভুতুড়ে বিল যাচাইয়ে গঠিত কমিটি আর্থিক অসঙ্গতি পেয়েছে উল্লেখ করে তাদের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

তবে এই প্রতিবেদনে নোট অব ডিসেন্ট বা অসম্মতি জানিয়েছেন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন। ম্যাট প্রোগ্রামের পরিচালকের আর্থিক অনিয়ম নিয়ে অন্য শিক্ষকেরাও ভীষণ ক্ষুব্ধ। তারা অবিলম্বে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ম্যাট প্রোগামের পরিচালক হিসেবে অনেক সিনিয়র শিক্ষককে ডিঙিয়ে ড. মিজানুর রহমানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রোগ্রামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাপানের একজন অধ্যাপককে তিনি অতিথি হিসেবে নিয়ে আসেন। এই জাপানি অধ্যাপককে অতিথি করা নিয়ে বিমানে যাতায়াতসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় ৩ লাখ টাকা খরচ দেখিয়েছেন তিনি।

বিদেশী অধ্যাপককে অতিথি করার ব্যাপারে বিভাগের এসি কমিটির অনুমোদন নেয়ার নিয়ম থাকলেও তা অনুসরণ করা হয়নি। জাপানি অধ্যাপককে অতিথি করার বিনিময়ে ব্যক্তিগত স্বার্থে অধ্যাপক মিজানুর রহমানও জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন মাস শিক্ষকতা এবং জাপানে যাতায়াত করেছেন বলে অভিযোগ।

ওই সময় অ্যাকাউন্টিং বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক আবদুল হাকিম। যিনি সম্পর্কে মিজানুর রহমানের ভাইরা হন। ফলে তার কাছে কোনো বিল গেলে কিছু না দেখেই তিনি তাকে স্বাক্ষর করতেন। পরে বিভাগের চেয়ারম্যান হন অধ্যাপক ড. রিয়াজুর রহমান। তিনিও যথারীতি বিলে স্বাক্ষর করতেন।

কিন্তু হঠাৎ কিছু দিন আগে তার কাছে কয়েকটি বিলের পরিমাণ অস্বাভাবিক মনে হলে তিনি আর স্বাক্ষর দেননি। এভাবে প্রায় দেড় মাসে অন্তত ১৮টি অননুমোদিত খাতে লক্ষাধিক টাকার বিলিং করেছেন প্রোগ্রাম পরিচালক মিজানুর রহমান। তবে বিলের নির্দিষ্ট পরিমাণ জানা যায়নি।

এ ব্যাপারে অ্যাকাউন্টিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রিয়াজুর রহমান বলেন, বিষয়টি আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমি দেশের বাইরে যাচ্ছি। এ নিয়ে পরে কথা বলবেন জানিয়ে ফোন কেটে দেন তিনি।

বিভাগ সূত্র জানায়, ম্যাট প্রোগ্রাম পরিচালনার জন্য তিনজনের একটি সমন্বয় কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে ড. মিজানুর রহমান পরিচালক, ড. হামিদ উল্লাহ ভুঁইয়া সহযোগী পরিচালক আর বিভাগের চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে সদস্য। ম্যাট প্রোগ্রাম পরিচালনা তথা ভর্তি পরীক্ষা নেয়া, প্রশ্নপত্র তৈরি করা, সিলেবাস প্রণয়ন, ক্লাস রুটিন তৈরি, শিক্ষার্থীদের ডাটাবেজ তৈরিসহ বিভাগীয় অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা শিক্ষকেরা বিশেষ দায়িত্ব হিসেবে সম্পাদন করেন। এ জন্য তারা বেতনভাতা পেয়ে থাকেন।

কিন্তু ম্যাট প্রোগ্রামের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান এসব খাতে আলাদা করে বিল তৈরি করেছেন। এমনকি ম্যাট প্রোগ্রামে ভর্তি পরীক্ষার খাতা অন্য শিক্ষক দেখার পরও ওই শিক্ষক এবং পরিচালক নিজের নামে বিল করেছেন। বিভিন্ন বিলের অসঙ্গতি চিহ্নিত করতে ৫ সদস্যের একটি যাচাই কমিটি করা হয়।

এ কমিটির আহ্বায়ক হলেন বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহমিনা খাতুন। সদস্যরা হলেন, অধ্যাপক ড. ধীমান কুমার সরকার, অধ্যাপক মাকসুদুর রহমান, অধ্যাপক ড. মাহমুদা আক্তার ও অধ্যাপক ড. মো: মহব্বত আলী। সর্বশেষ গত শনিবার ট্যাক্স নীতির ওপর একটি সেমিনারের আয়োজন করেন তিনি। যেখানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান প্রধান অতিথি ছিলেন। যদিও সেমিনারের ব্যাপারে বিভাগের চেয়ারম্যান বা এসি মিটিংয়ে অনুমোদন নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ। তবুও এই সেমিনারের অতিথিদের জন্য ঢাকা ক্লাব থেকে দুপুরের খাবার বাবদ ১ লাখ টাকার বিল নিয়েছেন অধ্যাপক মিজানুর রহমান।

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত অ্যাকাউন্টিং বিভাগের এসি মিটিং হয়। সেখানে অ্যাজেন্ডা হিসেবে ম্যাট প্রোগামের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমানের ভুতুড়ে বিল তথা অননুমোদিত খাতে অতিরিক্ত বিল করা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। আর্থিক অসঙ্গতি যাচাই কমিটি একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনও জমা দেন; যাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, অধ্যাপক মিজানুর রহমান যেসব খাতে বিলের যে ভাউচার করেছেন তাতে অসঙ্গতি রয়েছে।

কেননা ম্যাট প্রোগ্রামে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া, প্রশ্নপত্র তৈরি করা, সিলেবাস প্রণয়ন, ক্লাস রুটিন তৈরি, শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য ডাটাবেজ তৈরি করা বিষয়ে তিনি আলাদা বিল জমা দিয়েছেন। অথচ এ জন্য সমন্বয় কমিটি ও স্টাফ রয়েছে। এসব কাজ তারাই করেন। যেসব খাতে ভুতুড়ে বিল করে টাকা নিয়েছেন সেগুলো বিভাগে ফেরত দেয়ার সুপারিশ করেছে যাচাই কমিটি। পাশাপাশি অসচেতনভাবে অনিয়ম হয়ে থাকলে বিষয়টি অ্যাকাডেমিক কমিটিকে পুনর্বিবেচনার (ক্ষমা) কথা বলেছেন।

আর্থিক অনিয়ম যাচাই কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. তাহমিনা খাতুনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেন তবে কোনো মন্তব্য লিখতে না করেন। এ বিষয়ে বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন বলেন, এসি মিটিংয়ে আমি অনিয়ম যাচাই কমিটির প্রতিবেদনের সাথে দ্বিমত পোষণ করে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি। কারণ কেউ অনিয়ম করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। প্রতিবেদনে অনিয়মের টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলা হলেও অভিযুক্ত শিক্ষককে ক্ষমা করার কথাও বলা হয়েছে। বিষয়টি সাংঘর্ষিক।

সর্বোপরি অভিযুক্ত শিক্ষক মিজানুর রহমানকে ফোন করলে তিনি বলেন, যাচাই কমিটির পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন আমার হাতে আসেনি। তা ছাড়া বিষয়টি এসি মিটিংয়ে ফয়সালা হয়ে গেছে। আমি কোনো অনিয়ম করিনি; যা করেছি বিভাগের এসি মিটিং ও সমন্বয় কমিটির সাথে আলোচনা করেই করেছি।

জাপানি অধ্যাপককে আনা হয় আলোচনার মাধ্যমেই। ম্যাট প্রোগ্রাম শুরুর সময় জনবল সঙ্কট ছিল। অনেক সময় হায়ার করতে হয়েছে। ট্যাক্স-বিষয়ক সেমিনারের ব্যাপারে সবার সাথে আলোচনা করেছি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সত্য নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে বিভাগের চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগের কথা বলেন তিনি।