Home ক্যাম্পাস খবর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রয়াত মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যার...

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রয়াত মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যার শিক্ষার্থীদের অন্তরাত্মার একটি জাগ্রত স্বত্তা: চৌদ্দতম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলী


শাহ মনসুর আলী নোমান : একজন আদর্শ শিক্ষকের কখনও মৃত্যু হয় না; তিনি তাঁর সততা, দক্ষতা, যোগ্যতা, দেশপ্রেম, ত্যাগের মহিমা ও নৈতিকতার মাধ্যমে ছাত্রদের মনোজগতে অমরত্বের বীজ বপন করে যান।

২৭ জুলাই শাবিপ্রবি’র তৃতীয় উপাচার্য ও এই বিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যারের চৌদ্দতম মৃত্যুবার্ষিকী।

তিনি সমকালীন বিরল একজন আদর্শবান শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের শুধু স্বপ্নই নয়, স্বপ্ন পূরণের পথ বাতলে দিতেন এবং সঠিক রাস্তা দেখাতেন।

আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজ সততা নির্বাসিত, শিষ্টাচার দুর্লভ, বেশীর ভাগ শিক্ষার্থীরা আজ পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত। সমাজ ও রাষ্ট্রে নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অগ্নিমশাল নিয়ে ব্রতী যে শিক্ষক তিনিই পারেন আলোর পথ দেখাতে। আর সেই আলোর ফেরিওয়ালা প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যারের কর্ম ও শিক্ষাজীবন ছিল সাফল্যে পরিপূর্ণ। গণতন্ত্র, সুশাসন, কথা বলার স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং সমাজকর্ম শিক্ষার প্রসারে তিনি অনবদ্য ভূমিকা রেখে গেছেন। প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যারের সক্রিয় উদ্যোগ এবং বলিষ্ট নেতৃত্বে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রা শুরু করে সমাজকর্ম বিভাগ এবং ১৯৯৪ সালে সমাজকর্ম বিভাগের প্রথম ব্যাচের ক্লাস শুরু হয়।

আমি স্যারের সরাসরি ছাত্র না হলেও আমরা একই উপজেলার অধিবাসী হওয়াতে স্যারের সাথে ব্যক্তিগতভাবে আমার ঘনিষ্ট হবার সুযোগ হয়েছিল।

আমার যতদূর মনে পড়ে ১৯৯৮ সাল থেকে স্যারের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সিলেটে এবং নবীগঞ্জে স্যারের প্রায় সবক’টি সভা-সেমিনারে শ্রোতা হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। তখন আমি এম.সি কলেজে (সরকারি মুরারী চাঁদ কলেজ, সিলেট) স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলাম। এমনকি স্যার ভিসি এবং সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক থাকাকালীন সময়ে স্যারের অফিসে বেশ কয়েকবার দেখা হয়। তিনি আমাদেরকে বেশ সময় দিতেন এবং নবীগঞ্জবাসীর খোঁজ খবর নিতেন। ¯’ানীয়, জাতীয় সকল পর্যায়ের মানুষের সাথে খুব ভাল একটি সুসম্পর্ক ছিল স্যারের। আমার যতদূর মনে পড়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে স্যার বলতেন, “মানুষকে ভালবাসার মাধ্যমে আল্লাহর সš‘ষ্টি পাওয়া যায়, সবাইকে নিজ নিজ অব¯’ান থেকে সমাজের কল্যাণে কাজ করে যেতে হবে। দেশ-জাতি ও সমাজের উন্নয়নে নারী শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। শিক্ষা মানুষের মানবীয় বৃত্তিগুলোর বিকাশ ঘটায়। আমাদের স্বাধীনতার মূল চেতনা সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে আমাদের দলমত নির্বিশেষে কাজ করে যেতে হবে।”

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত স্যার বলেন, “মানুষের মঙ্গলচিন্তা শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে সবসময় আ”ছন্ন করে রাখত। তার জীবনে সাম্যবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা ছিল ধ্রুবতারার মতো। সব ধরণের গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা ও কুটমন্ডুকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সো”চার। তাঁর নৈতিকতা থেকে বর্তমান প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে।” (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো; ০৭/০৮/২০১০)

শাবিপ্রবি’র সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আমিনুল হক ভূঁইয়া বলেন, “প্রফেসর এম হাবিবুর রহমান ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, তাই তাঁর গড়া বিভাগের কার্যক্রমে এর পরিচয় পাওয়া যায়। (সূত্র: দৈনিক সিলেটের ডাক; ২৪/০৮/২০১৬)

তিনি ছিলেন লিডার অব দ্যা লিডার্স, একজন সক্রিয় চিন্তার মানুষ আলোর ফেরিওয়ালা, সুচিন্তাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজ গবেষক। মুক্তবুদ্ধির প্রবক্তা, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, বৈষম্যবিরোধী, সু-শাসনের একজন দিশারী, এই খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ এবং সমাজসেবীর জন্ম হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার চান্দপুর গ্রামে (বাউসা ইউনিয়ন)।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যার ছিলেন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির একজন জনপ্রিয় নেতা; এবং তিনি রাবি’র শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপ-উপাচার্য এবং রেজিষ্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি শাবিপ্রবি’র সমাজকর্ম বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন হিসেবে খুবই দক্ষতার সহিত দায়িত্ব পালন করেন। স্যার, ১৯৯৭ সালে শাবিপ্রবি’র ভিসি হিসেবে যোগদান করেন। অবসর গ্রহণের পর সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন উনার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। এই স্বনামধন্য ভিসি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যারের আমলে ১৯৯৮ সালে শাবি’র প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়।

দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ এবং ৩৬০ আউলিয়ার পদ স্পর্শে ধন্য পূণ্যভূমি সিলেট বিভাগে জন্মগ্রহণ করেছেন অনেক জ্ঞানী-গুণী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও বিজ্ঞ জনেরা। সিলেটরত্ন সাবেক স্পীকার, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব, বর্ষিয়ান কূটনীতিবিদ মরহুম হুমায়ুন রশিদের প্রাণপন প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিজ্ঞান প্রযুক্তি, শিক্ষা ও গবেষনায় অনবদ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।

প্রফেসর মোঃ হাবিবুর রহমান স্যার একজন সুদক্ষ প্রশাসক হিসেবে কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছিলেন এবং তাঁর আমলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও সুকীর্তি বৃদ্ধি পায়। তিনি যেমন পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লেখাপড়ার মধ্যেই তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।

প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যার আজকে আমাদের জন্য রোলমডেল। তিনি যে কর্মগুলো রেখে গেছেন সেটাকে লালন ও পালন করতে পারলে প্রতিষ্ঠিত হবে একটি সুখী, সুন্দর ও আলোকিত বাংলাদেশ। মুক্ত চিন্তা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একজন আদর্শিক সৈনিক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যার মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সো”চার ছিলেন। সামাজিক প্রচলিত কুসংস্কার, অন্ধকার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করতে হলে সাংস্কৃতিক চর্চার কোন বিকল্প নেই বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি আধুনিক রাষ্ট্র এবং উদার সমাজ ব্যব¯’া গঠনের স্বপ্ন দেখেছেন আজীবন। বিভিন্ন সময় তিনি বিভিন্ন দলমতের সিনিয়র, জুনিয়র, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে বসতেন এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতেন। তিনি সহজেই ক্ষমা করতে পারতেন। প্রফেসর হাবিবুর রহমান স্যারের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক স্মরণ সভায় শাবিপ্রবি’র বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন স্যার বলেন, ‘হাবিবুর রহমান একজন আদর্শ শিক্ষক, ভাল গবেষক, দূরদর্শী প্রশাসক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রায় তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের শিক্ষক, যিনি দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে আমৃত্যু, সত্য, সুন্দর, প্রগতি ও আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে গেছেন।

স্যার ব্যক্তিগত ও সাংসারিক জীবনেও খুবই বিনয়ী, সফল এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। স্যারের সন্তানেরা উ”চ শিক্ষিত এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। স্যারের সন্তান এনামুল হাবিব (যুগ্ম সচিব) বর্তমানে ¯’ানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে এলজিএসপি-৩ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কর্মরত। (তিনি পূর্বে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা ও রংপুর জেলার ডিসি ছিলেন)।

মানবতা ও আলোর ফেরিওয়ালা এই কীর্তিমান পুরুষ ২৭ জুলাই ২০০৬ সালে অগণিত শুভাকাঙ্খী, শিক্ষার্থী ও আপনজনকে ছেড়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। ২৭ জুলাই প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যারের মৃত্যু দিবস। স্যারের ১৪তম মৃত্যু বার্ষিকীতে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। মহান আল্লাহপাক স্যারকে তাঁর সু-কর্মের জন্য জান্নাতের সর্বোচ দরজা প্রদান করুন। আমিন।

শাহ মনসুর আলী নোমান : ভিসি মহোদয়ের একান্ত সচিব, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ