Home আইটি হোমিকরসিন: বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত নতুন অ্যান্টিবায়োটিক

হোমিকরসিন: বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত নতুন অ্যান্টিবায়োটিক


হোমিকরসিন নামে একটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের মাধ্যমে ইতিহাস রচনা করলেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা। পাটের বীজ থেকে পাওয়া ব্যাকটেরিয়া থেকে তারা খুঁজে বের করেছেন এই অসামান্য অ্যান্টিবায়োটিকটি, যা শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে বহু রোগীর প্রাণ বাঁচাবে। গত ২৭ মে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা ন্যাচারের ‘সাইন্টিফিক রিপোর্ট্স’ জার্নাল তাদের এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। চলুন, এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের ব্যাপারে আরো কিছু জেনে নেই।

পাট অনেক আগে থেকেই মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছে। তাই বিভিন্ন অঙ্গনে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ কাজও হয়েছে এই সোনালী আঁশ নিয়ে।

বাংলাদেশের স্বনামধন্য জিনতত্ত্ববিদ প্রয়াত ড. মাকসুদুল আলম ২০১০ সালে আবিষ্কার করেন পাটের জিন নকশা। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা মোবারক আহমেদ খান পাট থেকে ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিস করেছেন। তার মধ্যে ২০০৯ সালে জুটিন (ঢেউটিন) এবং ২০১৮ সালে সোনালী ব্যাগ (পলিথিন) উল্লেখযোগ্য।

আর ২০২১ এর এই মাঝামাঝিতে সেই পাট থেকেই দেশের গবেষকরা খুঁজে বের করলেন জীবন বাঁচানোর ঔষধ। ব্যাকটেরিয়া ও পাটের বৈজ্ঞানিক নাম থেকেই ‘হোমিকরসিন’ অ্যান্টিবায়োটিকটির নামকরণ করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুপ্রাণ ল্যাবে ৩ বছর ধরে চলমান গবেষণাটিতে কাজ করেছেন ৭ জন গবেষক। তন্মধ্যে বায়োজ্যেষ্ঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিভাগের অধ্যাপিকা হাসিনা খান, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম এবং জীন প্রকৌশল ও জৈব প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আফতাব উদ্দিন ছিলেন নেতৃস্থানীয়। তাদের সাথে কাজ করেছেন বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলের (বিসিএসআইআর) সদস্য এএইচএম শফিউল ইসলাম মোল্লা। এছাড়া গবেষক হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিভাগের ৩ জন শিক্ষার্থী শাম্মী আক্তার, মাহবুবা ফেরদৌস, বদরুল হায়দার এবং আল আমিন।

দীর্ঘদিন ধরে পাট নিয়ে গবেষণারত হাসিনা খান পাটের জীবন রহস্য উদঘাটনের সময় এর ভেতর তিনি সন্ধান পান বিভিন্ন ধরনের অণুজীবের। মুলত এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানার আগ্রহ থেকেই শুরু হয় নতুন গবেষণার।

গবেষণায় বেরিয়ে আসে দারুণ সব তথ্য। পাটের তন্তুর খাঁজে খাঁজে ৫০টিরও বেশি অণুজীব বাস করে। এদের মধ্যে ‘স্টেফাইলো কক্কাস হোমিনিস’ নামক একটি ব্যাকটেরিয়া আছে যা নিজের শরীর থেকে এমন কিছু তৈরি করে, যাতে অন্য ব্যাকটেরিয়াগুলো মারা যায়। অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়াটি রীতিমত একটি সাক্ষাত অ্যান্টিবায়োটিকের মতো আচরণ করছে। এই অ্যান্টিবায়োটিকের ৫টি ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করেছেন গবেষকগণ। এর মধ্যে দুটির ব্যাপারে ইতোমধ্যে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা আছে। বাকি ৩টির কার্যকারিতা নিয়ে এখনো কাজ চলছে।

যাদের দেহে অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না এমন রোগীদের দেহে খুব ভালোভাবেই কাজ করতে পারে হোমিকরসিন। বেশ কিছু শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে মোক্ষমভাবে লড়াই করতে পারে এই অ্যান্টিবায়োটিক। সুপার বাগ নামে পরিচিত এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে, যার প্রচলিত কোন অ্যান্টিবায়োটিকেই প্রতিকার হয় না। এগুলোর ক্ষেত্রেও সফল হয়েছে এই নতুন এন্টিবায়োটিক।

অ্যান্টিবায়োটিক মূলত দুই ধরনের হয়। একটি হলো ব্রড স্পেক্ট্রাম, যেটা সব ধরনের অণুজীবে কাজ করে। আরেকটা হচ্ছে গ্রাম-পজিটিভ এবং গ্রাম-নেগেটিভ। শুধুমাত্র একটি ব্রড স্পেক্ট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে একসাথে অনেক জীবাণুর বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। তাই গবেষকরা এই ক্যাটাগরিকেই খুব বেশী কার্যকর মনে করে এসছেন। কিন্তু সমস্যার ব্যাপার হচ্ছে- একবার যদি তার বিপক্ষে বিপক্ষ অণুজীবটি প্রতিরোধ দাঁড় করিয়ে ফেলে, তখন অ্যান্টিবায়োটিকটি আর কাজ করে না। আনন্দের ব্যাপার হলো- হোমিকরসিন ব্রড স্পেক্ট্রাম ক্যাটাগরিতে পড়েনি। শুধু তাই নয়, এটি গবেষকদের গ্রাম পজিটিভ-নেগেটিভ ক্যাটাগরির ব্যাপারেও পূর্বের ধারণা পাল্টে দিয়েছে।

হোমিকরসিন অ্যান্টিবায়োটিক কত দ্রুত জনসাধারণের নিকট পৌছাবে সেটা নির্ভর করছে সরকার ও ফার্মাসিউটিক্যাল্স কোম্পানিগুলো থেকে পর্যাপ্ত ফান্ডিংয়ের উপর। সাধারণত যে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বাজারজাত করতে কমপক্ষে ৫ বছর লেগে যায়। তাই প্রাণ রক্ষাকারী এই ঔষধের দ্রুত যোগান নিশ্চিতকরণে সরকারী ও বেসরকারী সব মহলের যৌথ উদ্যোগ সময়ের দাবী।