Home ব্যাংক-বীমা ব্যবসাবান্ধব বনাম জনবান্ধব বাজেট

ব্যবসাবান্ধব বনাম জনবান্ধব বাজেট


সদ্য উপস্থাপিত বাজেট নিয়ে একটি অযথা বিতর্ক চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন একটি মহল। বাজেট ব্যবসাবান্ধব, জনবান্ধব নয়। ভাবখানা এমন, ব্যবসা ও শিল্পবান্ধব হলে তা জনবান্ধব হতে পারে না। গত বছর এই সময় অনুরূপ আরেকটি বিতর্ক শুরুর চেষ্টা করেছিলেন একই মহল। তারা প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছিলেন বাজেট জীবন সংরক্ষণের নাকি জীবিকা সংরক্ষণের। যেন এ দুটো বিষয় আলাদা। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন চলতি বাজেটটি জীবন এবং জীবিকা- দুটো দিকেই গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

এখন আর জীবন বনাম জীবিকা নিয়ে তেমন বিতর্কের অবতারণা দেখতে পাই না। তবে জীবন যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। জীবন বাঁচাতেও যে জীবিকার দরকার সে কথাই বা অস্বীকার করার উপায় কোথায়? তাই দুটো দিকের বাস্তবসম্মত সমন্বয় ঘটিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে সরকারের নীতি কৌশল।

এই ধারাবাহিকতায় জীবন বাঁচানোর জন্য টিকা ও স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুরক্ষার ওপর যেমন জোর দেওয়া হয়েছে তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেশীয় শিল্পায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবারের বাজেটে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা না হলে মানুষের আয়-রোজগার বাড়বে কীভাবে? সরকার একা তো পুরনো ও নতুন গরিবদের সবাইকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। ব্যক্তি খাত নির্ভর এই অর্থনীতিতে তাই সরকার যদি ব্যবসাবান্ধব হয় তাহলে জনগণের কল্যাণও নিশ্চিত করা যায়।

কর্মসংস্থানের বড় ক্ষেত্রই তো ব্যক্তি খাত। আর এ বাজেটে সেই কারণেই ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতের জন্য সহায়ক কর নীতির প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব কর সুবিধা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে নিশ্চয় ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরুদ্ধার করা যাবে এবং জনগণেরও কর্মহীনতা কমবে। তাই একটি আরেকটি থেকে আলাদা নয়। অযথা এই বিতর্ক না করে আসুন আমরা দেখি ব্যবসা ও শিল্প সহায়ক কী ধরনের কর প্রস্তাবনা করা হয়েছে এই বাজেটে।

ব্যবসাবান্ধব কর নীতিই এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। এক ব্যক্তির মালিকানাধীন কোম্পানি ও কয়েকজন ব্যক্তির মালিকানাধীন কোম্পানির কর হার যথাক্রমে ৭.৫ শতাংশ এবং ২.৫ শতাংশ কমিয়ে ৩২.৫ থেকে ২৫ শতাংশ এবং ৩২.৫ থেকে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলমান অবস্থায় এ উদ্যোগের ফলে ছোট কোম্পানিগুলো এর সুফল পাবে। নতুন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারাও উপকৃত হবেন। কর্মসংস্থান বাড়বে। আর ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে যারা করজালের বাইরে ছিলেন তারা কর দিতে উৎসাহিত হবেন। ফলে রাজস্ব লক্ষ্য অর্জনে তা সহায়ক হবে বলেই মনে হচ্ছে।

এছাড়াও করোনা চিকিৎসার যন্ত্রাদি আমদানিকে করমুক্ত রাখা, জুসার, ব্লেন্ডার ইত্যাদি গার্হস্থ্য ব্যবহারের বৈদ্যুতিক যন্ত্রাদির দেশীয় উৎপাদকদের সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগগুলো নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী। মোটরগাড়ি উৎপাদনে ১০ বছরের কর-অবকাশ দেওয়া হয়েছে। কর অবকাশের সুবিধা প্রস্তাব করা হয়েছে অ্যাগ্রো-প্রসেসিং এবং চিকিৎসা উদ্যোক্তাদের জন্যও।

ব্যক্তি খাতের চিকিৎসা উদ্যোক্তাদের মধ্যে যারা ঢাকার বাইরে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করবেন তাদের জন্যও কর রেয়াত রয়েছে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ স্বাস্থ্যসেবার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ব্যক্তি খাতের ওপর নির্ভরশীল। বিবিএস এর সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, আউটপেশেন্টদের মধ্যে ১৪-১৮ শতাংশ মানুষ সেবা নিতে সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান এবং ইনপেশেন্টদের মধ্যে এ হার ৫৪-৬০ শতাংশ। কাজেই স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের জন্য কর প্রণোদনা নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী।

তবে কিছু কিছু কর প্রস্তাব নিয়ে আবার ভাবা উচিত বলে মনে হচ্ছে। মোবাইল আর্থিক সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ৫ থেকে ৭.৫ শতাংশ করপোরেট কর ধরার প্রস্তাবটি মোটেও যথোপযুক্ত হয়নি। আখেরে এই কর গ্রাহকের ওপরই বর্তাবে। এই গ্রাহকেরা কার্যত খুব অসহায় ও কম আয়ের মানুষ।

করোনাকালে এই সেবা দানকারীরা যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে সেজন্য তাদের শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করার প্রয়োজন ছিল। নিশ্চয় শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। আরও কিছু কর প্রস্তাব নিয়ে ভাবার সুযোগ আছে। যেমন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় চাপে পড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের ওপর কর আগের জায়গায় না রেখে কমানো উচিত, তামাক পণ্য উৎপাদনকারীদের আয়ের ওপর কর আগের জায়গায় (৪৭.৫ শতাংশ সার চার্জসহ) না রেখে ৫০ শতাংশ করা উচিত।

তামাক পণ্যে সম্পূরক শুল্কের প্রস্তাবটিও হতাশ করেছে। কোনো তামাক পণ্যের ওপরই সম্পূরক শুল্ক হার বাড়ানো হয়নি। সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপের যে প্রস্তাব করা হয়েছিল সেটি বাস্তবায়ন করা গেলে সরকার বাড়তি রাজস্ব পেত ৩,২০০ কোটি টাকা। এছাড়াও উচ্চ আর প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেট প্রতিটির দাম মাত্র ০.৫ টাকা করে বাড়ানো হলেও, কম দামি সিগারেট, বিড়ি, জর্দা ও গুলের দাম তো বাড়ানোই হয়নি। অথচ প্রয়োজন ছিল কর বাড়িয়ে সবাইকে একটা ধাক্কা দেওয়ার।

স্বাস্থ্য খাতে গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে বাজেট বরাদ্দ দেওয়ার যে আশা অনেকে করেছিলেন সে রকমটি হয়নি। মোট বরাদ্দ প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। আর বাজেটের শতাংশ হিসেবে এটি ৫.৪ শতাংশ। প্রত্যাশা ছিল অন্তত ৭ শতাংশ বরাদ্দের। সম্ভবত বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতার নিরিখে এ খাতে বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানী হয়েছেন বাজেট প্রণেতারা। তবে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে কেবল বরাদ্দ বাড়ালে সুফল পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে হেলথ ভাউচার চালু করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন এমন মানুষদের একটি অংশের দায়িত্ব সরকার নিলে তা খুবই কার্যকর হবে। এ রকম একটি পাইলট কর্মসূচি করোনা রোগীদের নিয়ে কি করা যায় না?

কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে মূল লক্ষ্যের জায়গায় রেখে শিল্প ও ব্যবসাবন্ধব রাজস্ব নীতির পাশাপাশি মানুষের সার্বিক সুরক্ষার দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে আসন্ন বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে। তবে বিপন্ন জনগণের আপদকালীন সুরক্ষার জন্য নগদ সহায়তাসহ অন্যান্য সুরক্ষা উদ্যোগগুলোকে আরও বিস্তৃত করার সুযোগ ছিল।

শিক্ষায় বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানো হলেও ‘ডিজিটাল ডিভাইড’-এর কারণে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা যেন পিছিয়ে না পড়ে সেদিকে আরেকটু নজর দেওয়া যেত বলে মনে হয়। এ জন্য ইন্টারনেট ও স্মার্ট ডিভাইস উভয়েরই দাম কমানো উচিত। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে চলতি বছরের প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ আসন্ন বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি (অর্থাৎ মোট জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৮ শতাংশ)। তবে বাস্তবায়নে দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে উপকারভোগী নির্বাচনে ডিজিটাল টার্গেটিং ব্যবহার করে ভুল-ত্রুটি ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসা খুবই জরুরি। সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনার প্রাদুর্ভাব যে হারে বাড়ছে সে বিবেচনায় জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য একটি আলাদা তহবিল গঠন করার কথাও ভাবা দরকার।

বাজেট ও সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে যেকোনো আলাপেই যেটা আমাদের মনে রাখা দরকার তা হলো- এখন টাকা নয়, টিকাই প্রধান বিবেচ্য। প্রবৃদ্ধি, ঘাটতি অর্থায়ন- এগুলোর চেয়েও ৬০-৭০ শতাংশ মানুষকে কীভাবে দ্রুত টিকা দেওয়া যায় সেই প্রশ্নটিই এখন মুখ্য। টিকা পেলেই মানুষের মনে স্বস্তি আসবে। ব্যবসায়ী আস্থাও বাড়বে। এতে মানুষকে বাঁচানো এবং অর্থনীতিকে গতিশীল করা- এই দুটি লক্ষ্যই অর্জিত হবে। জীবন ও জীবিকার স্বার্থেই যেকোনো মূল্যে টিকা সংগ্রহের বিকল্প নেই।

ড. আতিউর রহমান ।। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি