Home লাইফস্টাইল ‘বঙ্গবন্ধুর চিন্তা জুড়ে ছিল শুধুই মানুষ, তিনি সারা জীবন মানুষের জন্য কাজ...

‘বঙ্গবন্ধুর চিন্তা জুড়ে ছিল শুধুই মানুষ, তিনি সারা জীবন মানুষের জন্য কাজ করে গেছে-ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ


বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ এভাবেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মূল্যায়ন করেন। তিবি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু সব সময় দরিদ্র মানুষের কল্যাণের কথাই চিন্তা করতেন। আর তাই তিনি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অসীন হবার পর দরিদ্র মানুষের জন্য এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যা আগে কেউ ভাবেননি। তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেছিলেন। পরিবারভিত্তিক জমির সর্বোচ্চ সিলিং একশত বিঘা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, যাতে দেশের জমিগুলো সামান্য কিছু পরিবারের হস্তগত না হয়। ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি পত্রিকার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এম এ খালেক। তার সাক্ষাৎকারের বিবরণ এখানে উল্লেখ করা হলো:

দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জনকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

Progoti-Insurance-AAA.jpg
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতা অর্জন করে তখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই ভঙ্গুর। সেই সময় দেশের রাস্তা-ঘাট সব বিধ্বস্ত ছিল। অবকাঠামোগত দিক ছিল সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত। গ্রামীণ অর্থনীতি, বিশেষ করে কৃষি ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। প্রশাসনিক ব্যবস্থাও ছিল খুবই দুর্বল। এমনই এক অবস্থায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করে দেখলেন, কিভাবে একটি দেশকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানই সঠিকভাবে কাজ করছিল না। তাঁর প্রথম কাজই ছিল দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সচেষ্ট হওয়া।

বঙ্গবন্ধু দেশের আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামোগত সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে তা দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এখানে একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু সারা জীবন মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন। তাঁর চিন্তা জুড়ে ছিল শুধুই মানুষ। তিনি মানুষের কল্যাণকেই সব সময় প্রাধান্য দিতেন। একই সময় ভারত থেকে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি শরণার্থী ফিরে এলো। এদের পুনর্বাসন নিয়েও তাঁকে চিন্তা করতে হয়। অভ্যন্তরীণভাবেও কয়েক কোটি মানুষ দুঃস্থ হয়ে পড়েছিল। শিল্প-কারখানাগুলো ছিল প্রায় বিধ্বস্ত। বাংলাদেশে যেসব শিল্প-কারখানা ছিল তার অধিকাংশের মালিক ছিলেন পাকিস্তানিরা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বা তার পরে পাকিস্তানি শিল্প মালিকদের প্রায় সবাই তাদের দেশে চলে যায়। ফলে শিল্প-কারখানাগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। আর সেই সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল কার্যত কৃষি নির্ভর। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল মাত্র ৬ শতাংশের মতো। কৃষিই ছিল সেই সময় আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। কাজেই বঙ্গবন্ধু প্রথমেই দেশের কৃষি খাতের উন্নয়নের উপর জোর দেন। তিনি কৃষি উন্নয়নের জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কৃষি এবং কৃষকই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল কেন্দ্র। যেমন সেই সময় কৃষকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সার্টিফিকেট মামলার সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। সেই সব মামলা বাতিল করা হয়। কৃষি খাতে ঋণদানের ব্যবস্থা করা হয়। জমি যাতে মুষ্ঠিমেয় কিছু মানুষের হাতে পুঁঞ্জীভূত না হয় সেজন্য ব্যক্তিগত জমির ১০০ বিঘা সর্বোচ্চ সিলিং নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেয়া হয়। সমবায়ভিত্তিক ঋণদানের ব্যবস্থা করা হয়। টেস্ট রিলিপ দেয়া হয় কোটি কোটি টাকা। সমবায় ঋণ দেয়া হয় ৫ কোটি টাকা, টেস্ট রিলিফ দেয়া হয় ১৬ কোটি টাকা। তখন ৫ কোটি বা ১০ কোটি টাকা অনেক টাকা ছিল। একই সময় তিনি কৃষি খাতের জন্য যান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রয়োগের চেষ্টা করেন। আগে আমাদের দেশের কৃষি ব্যবস্থা বলতে সেকেলে ধরনের চাষাবাদকেই বুঝাতো। বঙ্গবন্ধু সেকেলে কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের সূচনা করেন। উন্নত বীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। বৃক্ষ রোপনের উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেছিলেন। সমুদ্র সীমানা ব্যবহারের আইনও সেই সময় প্রণীত হয়। সেই আইনে বলা ছিল, কেউ যদি আমাদের সমুদ্র সীমা নিয়ে আপত্তি করে তাহলে আমরা আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে তার মীমাংসা করবো। বঙ্গবন্ধু দেশের পুনর্গঠনে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি দুর্যোগের কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক খাদ্য সহায়তা প্রদান করেনি। সেই সময় দেশের অভ্যন্তরে অনেকেই নিজেদের আখের গোছানোর জন চুরি করতে শুরু করে। সেই সময় দুর্নীতি বেড়ে গিয়েছিল। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী মজুতদারি শুরু করে। ফলে দ্রব্য মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে। দরিদ্র মানুষের নিকট খাদ্য পৌঁছানো একটি বিরাট সমস্যায় পরিণত হয়। ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এতে প্রচুর মানুষ মারাও গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যেহেতু মানুষকে নিয়ে ভাবতেন তাই তিনি সমবায় পদ্ধতিতে চাষাবাদের কথা চিন্তা করেন। এই সমবায় পদ্ধতির মূল লক্ষ্য ছিল কারো জমি অধিগ্রহণ করা হবে না। জমির মালিকানা ঠিকই থাকবে শুধু আবাদ করা হবে সমবায় ভিত্তিতে। এতে জমির উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। জমির মালিকানা অনুসারে সংশ্লিষ্টরা ফসলের ভাগ পাবেন। যাদের জমি নাই তারা অন্যের জমিতে শ্রম দিবে এবং সেই শ্রমের বিনিময়ে ফসলের অংশ পাবে। বঙ্গবন্ধু যদি তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারতেন, তাহলে সরকারের হাতে টাকার কোনো অভাব থাকতো না। এখন ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও হচ্ছে মাত্র ৯ শতাংশ। কিছু মানুষ বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলছেন কিন্তু ঠিক মতো ট্যাক্স প্রদান করেন না। বঙ্গবন্ধু বিত্তবানদের নিকট থেকে ট্যাক্স আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর নির্মম হত্যাকান্ডের পর সেই উদ্যোগ থেকে যায়। তখন রাষ্ট্রীয় ফোকাস মানুষ থেকে পুঁজিতে চলে যায়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর সব কাজের লক্ষ্য ছিল মানুষ। আর পরবর্তী সরকারগুলোর সব কাজের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় পুঁজি বা অর্থ। বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরতা বেড়ে যায়। বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্থায়নের বেশির ভাগই আসতো বৈদেশিক আর্থিক সহায়তা ও ঋণ থেকে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের উপর তেমন একটা জোর দেয়া হয় নি। ’৮০ দশকে এই প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পায়। সেই সময় গড় জিডিপি’র হার দাঁড়ায় ২দশমিক ৪ থেকে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত। ’৯০ এর আবার যখন গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটলো তখন আবারো জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে থাকে। বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কৃষির উপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর কৃষি খাতের উপর তেমন কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় নি। কৃষিকে অবহেলা করা হয়। এই সময় শিল্পের উপর জোর দেয়া হয়। বলা হতো, শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে খাদ্য চাহিদা আমদানির মাধ্যমেও মেটানো যাবে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবারো যখন ক্ষমতায় আসে তখন আবারো কৃষির উপর জোর দেয়া হয়। এই সময় উন্নয়ন সহযোগীদের আপত্তি উপেক্ষা করে কৃষি খাতে ব্যাপক ভর্তুকি দেয়া হয়।

একই সঙ্গে কৃষি খাতে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বাড়ানো হয়। কৃষি উপকরণের উপর ভর্তুকি দেয়া হয়। ফলে আমরা সেই সময় খাদ্য উৎপাদনের প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। পরবর্তীতে সরকার পরিবর্তন হলে আবারো কৃষি খাতের প্রতি অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। ফলে কৃষি খাতে কিছুটা হলেও মন্থরতা পরিলক্ষিত হয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রেও আমরা ধারাবাহিকতার অভাব লক্ষ্য করি। এক বছর হয়তো উচ্চ মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলো। পরের বছরই আবার তা মন্থর হয়ে পড়ে। এরপর ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হলে আবারো কৃষি খাতের উন্নয়ন শুরু হয়। একই সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে চমৎকার ধারাবাহিকতা পরিলক্ষিত হয়। ১০ বছর গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। করোনা শুরু হবার আগের অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। করোনাকালীন বিশ

অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে গেলেও বাংলাদেশ মোটামুটি ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে বিশে^র শীর্ষস্থানীয় ১০টি দেশের মধ্যে থাকবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ২০০৯ সালের পর থেকে দেশের অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠে আসবে। এটি হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাত্তোর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অর্জন। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের সামাজিক ক্ষেত্রেও চমৎকার উন্নতি সাধিত হয়েছে। এমন কি কোনো কোনো সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ পাকিস্তান এমনকি ভারতকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে। যেমন বাংলাদেশের দারিদ্র্য আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। শিশু এবং মাতৃ মৃত্যুর হার কমেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। প্রত্যাশিত গড় আয় বেড়েছে।

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন পাকিস্তান ও ভারতের চেয়ে বেশি। নারীর ক্ষমতায়নে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবার শীর্ষে রয়েছি। বাংলাদেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু তাই বলে অর্জনের পরিমাণও কম নয়। অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু সমাজে বিত্তবান এবং বিত্তহীনের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।

২০১০ সালের তুলনায় আয় বৈষম্য বর্তমানে অনেক বেশি। তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশের আয় বৈষম্য আশেপাশের কোনো কোনো দেশের তুলনায় কম। নিরাপত্তা বেষ্টনি, বিধবা ভাতা চালুকরণ ইত্যাদি প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে দারিদ্র্যের হার অনেকটাই কমেছে। তারপরও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বিত্তবান বিত্তহীনের বৈষম্য যদি আরো বাড়তে থাকে তাহলে বিপদ।

দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: আপনি দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বললেন। প্রচলিত ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম দারিদ্র্য বিমোচনে তেমন একটা সহায়ক নয় বলে আপনি ইতোপূর্বে বলেছিলেন। এই অবস্থায় উপযুক্ত ঋণের ভূমিকা কেমন হতে পারে বলে মনে করেন?

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ: প্রচলিত ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থায় ঋণ গ্রহীতারা ঋণের কিস্তি ফেরৎ দেয়ার ব্যাপারে বেশ সক্রিয়। প্রায় ৯৬ শতাংশ ঋণ ফেরৎ আসছে। এটাই বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়। কিন্তু প্রচলিত ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম দারিদ্র্য বিমোচনের তেমন একটা সহায়ক নয় এটা বিভিন্ন গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যারা ক্ষুদ্র ঋণ নিয়েছেন তাদের মধ্যে মাত্র ৯ দশমিক ৪ শতাংশ দারিদ্র্য সীমার উপরে উঠে আসতে পেরেছে।

আমরা গবেষণায় দেখেছি, মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে দারিদ্র্য সীমার উপরে উঠে আসতে পেরেছিল। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে দারিদ্র্য সীমার উপরে উঠে আসতে না পারার অন্যতম কারণ হচ্ছে যার টাকার দরকার ৫০ হাজার তাকে দেয়া হয়েছে ১০ হাজার। ফলে সেই টাকা তার কোনো কাজে আসেনি। এ ক্ষেত্রে আমি উপযুক্ত ঋণের কথা বলি। উপযুক্ত ঋণ হচ্ছে যার যেটুকু ঋণের প্রয়োজন তাকে সেটুকু ঋণ দেয়া, যাতে সে তার অর্থের চাহিদা মেটাতে পারে। আসলে শুধু টাকা দিলেই একজন উদ্যোক্তা সফল হতে পারে না। তার সঙ্গে আরো কিছু সহায়তা প্রয়োজন হয়। যেমন, পুঁজির সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হয়। প্রশিক্ষণ না পেলে কারো পক্ষে তার সামর্থ্যরে পুরোটা ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। একই সঙ্গে বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের দরকার আছে। কিভাবে একটি পণ্য বাজারজাতকরণ করতে হবে। কোথায় বাজারজাত করলে বেশি লাভবান হওয়া যাবে এসব বিষয়ে উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তথ্য প্রয়োজন হয়। কোথায় কোন পণ্যের চাহিদা বেশি এসব তথ্য জানা না থাকলে পণ্য বাজারজাতকরণে অসুবিধা হতে পারে। আমরা ঋণ গ্রহীতাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার উপর জোর দিয়ে থাকি। কারণ আমরা চাইনা তাদের ছেলে মেয়েরা অশিক্ষিত হয়ে থাকুক। তাহলে তারা ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে পারবে না। তাই তাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করা হয়। আগে মনে করা হতো ঋণ দিলেই একজন মানুষ তা ব্যবহার করে আর্থিক উন্নতি অর্জন করতে পারবে। কিন্তু এখন মনে করা হয় শুধু ঋণ দিলেই একজন মানুষ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি অর্জন করতে পারে না, যদি সেই ঋণের অর্থ পর্যাপ্ত পরিমাণে না হয় এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারে। ঋণটা এমনভাবে দিতে হবে যাতে মানুষ তা নিয়ে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজে লাগাতে পারে। উপযুক্ত ঋণের সাফল্যের হার খুবই সন্তোষজনক। পিকেএসএফ থেকে উপযুক্ত ঋণ দান করা হয়। ঋণদানের আগে আমরা তাদের সমস্যা চিহ্নিত করার চেষ্টা করি। তারপর সেই অনুযায়ী ঋণদানের ব্যবস্থা করি। ঋণদানের পর আমরা সব সময়ই তাদের নজরদারি করি যাতে তারা কোনো সমস্যায় পতিত না হয়। সমস্যা হলে আমরা তা সমাধানের জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করি। যারা উপযুক্ত ঋণ নিয়ে ভালো করছে তাদের জন্য আমরা আরো বড় আকারের ঋণদানের ব্যবস্থা করছি। এই ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। আমরা এটা বাড়ানোর চেষ্টা করছি।

দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে বলবেন কি গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বর্তমান সরকারে সাফল্য কেমন?

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ: আমি বলবো গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বর্তমান সরকারের সাফল্য অনেক। কৃষি খাত ছাড়াও কৃষি বহির্ভূত খাতে বর্তমান সরকার নানাভাবে সহায়তা দিয়ে চলেছে। বর্তমান সরকার আমলে কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক গবেষণা হয়েছে। বর্তমান সরকার আমলে কৃষি যান্ত্রিকায়নের ক্ষেত্রে বেশ জোর দেয়া হয়েছে। সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করছেন তার বেশির ভাগই গ্রাম এলাকায় অবস্থিত। এগুলো বাস্তবায়িত হলে গ্রামীণ অর্থনীতি অনেকটাই বদলে যাবে। বর্তমান সরকার শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যাবার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তা অত্যন্ত সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ।

ইতোমধ্যেই প্রতিটি গ্রামেই শহরের সুবিধা সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ সুবিধা চলে গেছে। তবে আমরা এখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাচ্ছি না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এটা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই অভিঘাত মোকাবেলার জন্য বিশে^র সবদেশকেই একযোগে এগিয়ে আসতে হবে।

দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: করোনাকালেও রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে এর কারণ কি?

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ: করোনাকালেও রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবাহের জন্য কি কারণ কাজ করছে সে ব্যাপারে আমি তেমন কোনো চিন্তা-ভাবনা করিনি। কিন্তু যেটা বলা হচ্ছে, এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে বেশি রেমিট্যান্স আসছে। অর্থাৎ আগের তুলনায় বেশি পরিমাণ রেমিট্যান্স বৈধ চ্যানেলে আসছে। আগে হুন্ডির মাধ্যমে বেশি রেমিট্যান্স আসতো। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিট্যান্সের উপর নগদ ২ শতাংশ আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে। যারা বিদেশ থেকে কর্মচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে আসছে তারা একবারে তাদের সমস্ত টাকা নিয়ে আসছে। মূলত এসব কারণেই রেমিট্যান্স প্রবাহ এতটা বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা দেশে আছেন তারা করোনার কারণে অসুবিধার মধ্যে রয়েছেন। ফলে তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য বেশি করে রেমিট্যান্স দেশে পাঠাতে হচ্ছে। কিন্তু এই অবস্থাতো বেশি দিন চলার কথা নয়। আমি আশা করবো আরো কিছু দিন এই অবস্থা চলতে থাকুক। কিন্তু এই অবস্থা বেশি দিন চলবে না যদি আমরা প্রশিক্ষিত জনশক্তি রফতানি করতে না পারি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেশ থেকে প্রশিক্ষিত জনশক্তি রফতানির উপর তেমন কোনো জোর দেয়া হচ্ছে না। প্রশিক্ষিত জনশক্তি রফতানি করা গেলে আমাদের এ খাতের আয় অনেকগুণ বাড়ানো সম্ভব। ২০১১ সালের একটি নীতিমালা আছে যাতে বলা হয়েছে বিদেশে দক্ষ জনশক্তি প্রেরণ করতে হবে। কিন্তু সেই নীতিমালা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। অনেকেই অদক্ষ লোককে দক্ষতার ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে বিদেশে প্রেরণ করছে। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বিদেশে গিয়ে সমস্যায় পড়েন। এখন সময় এসেছে ২০১১ সালের নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদেশ দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত লোককে প্রেরণ করার। এটা করা গেলে এই খাতের আয় অনেকগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে যে দেশে আমরা জনশক্তি রফতানি করবো সেই দেশের স্থানীয় চাহিদা নিরূপন করে সেই মোতাবেক জনশক্তি রফতানির ব্যবস্থা করতে হবে। জাপানে হয়তো এক ধরনের জনশক্তি প্রয়োজন আমরা যদি সেখানে সেই মোতাবেক জনশক্তি রফতানি করতে না পারি তাহলে কোনো কাজ হবে না। আবার সৌদি আরবে যে ধরনের জনশক্তি প্রয়োজন আমরা যদি তা না পাঠিয়ে অন্য দেশের চাহিদা মতো জনশক্তি রফতানি করি তাহলে কোনো কাজে লাগবে না। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, যখনই জনশক্তি রফতানির প্রসঙ্গ আসবে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে যে দেশে জনশক্তি পাঠানো হবে তার স্থানীয় চাহিদা কেমন। আর সেই মোতাবেক প্রশিক্ষিত জনশক্তি প্রেরণ করতে হবে। যে দেশে ডাক্তার প্রয়োজন আমরা যদি সেখানে শ্রমিক প্রেরণ করি তাহলে কোনো লাভ হবে না। এখানে কারিগরি প্রশিক্ষণের বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। বর্তমান সরকার আমলে কারিগরি শিক্ষার উপর বিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে। ফলে ইতোমধ্যেই দেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার অনেক বেড়েছে। ২০০৯ সালে এসএসসি পাশ করা মাত্র এক শতাংশ কারিগরি শিক্ষায় যেতো। এখন সেটা ১৭/১৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আগামীতে এটা আরো বৃদ্ধি পাবে। কারিগরি শিক্ষার হার বাড়ছে। একই সঙ্গে যে বিষয়টি দরকার তাহলো কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন, যে ব্যক্তিটিকে সৌদি আরব পাঠানো হবে তাকে কারিগরি শিক্ষার পাশাপাশি আরবি ভাষায় প্রাথমিক ধারণা দেয়া যেতে পারে। তাহলে চাকরি করার ক্ষেত্রে তাকে কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। এসব কাজ শুধু সরকারের উদ্যোগে করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি খাতকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।

দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি: করোনা পরবর্তী দেশে কর্মসংস্থানের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এই সঙ্কট সমাধানে কি ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে বলে মনে করেন?

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ: সরকার বিভিন্ন সেক্টরের জন্য আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছেন। এতে ব্যবসায়-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটলে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা সৃষ্টি হলে আবারো দেশে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলেই দারিদ্র্য বিমোচন সহজতর হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে প্রায় আড়াই কোটি/ তিন কোটি মানুষ কর্মরত আছে। কিন্তু সেখানে তো প্রণোদনা পৌঁছেনি। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে আর্থিক প্রণোদনা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি আবারো চাঙ্গা করার উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি আগের মতো চাঙ্গা হলে কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে।

এম এ খালেক: কেনো কোনো অর্থনীতিবিদ বলেন, ভোক্তাদের হাতে নগদ অর্থ প্রবাহ বাড়াতে হবে। এটা কিভাবে সম্ভব?

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ: চাহিদা না থাকলে তো কোনো পণ্য উৎপাদন করে কোনো লাভ হবে না। মানুষ যখন কর্মচ্যুত হয়ে বেকার হয়ে যায় তখন তাদের হাতে অর্থের প্রবাহ হ্রাস পায়। রেমিট্যান্স প্রবাহের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ প্রবাহ কিছুটা হলে বাড়াচ্ছে। কারণ রেমিট্যান্সের মাত্র ৩০ শতাংশের মতো বিনিয়োগ হয়। অবশিষ্ট অর্থ অন্যভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যাংকে টাকা পড়ে আছে কিন্তু মানুষের হাতে যাচ্ছে না। অর্থনীতি আবারো চাঙ্গা হলে মানুষের হাতে টাকা চলে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য উন্নত দেশ তাদের সাধারণ নাগরিকের হাতে সরাসরি ক্যাশ দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা তো সম্ভব নয়।