
দেশে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮২ সালে। এরপর চার দশক পেরিয়ে গেলেও এখনো খাতটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। সুশাসনের ঘাটতি, খেলাপি ঋণ, তহবিল সংকট প্রতিষ্ঠানগুলোকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে। তবে এর মধ্যেও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান ভালো করছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নিজেদের সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি মানুষের আর্থিক সেবার চাহিদা পূরণ করছে। এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ থাকলেও দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্ভাবনা অনেক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বব্যাপী বন্ড ও ইকুইটির বাজার সৃষ্টিতে অনবদ্য অবদান রাখছে এনবিএফআই খাত। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণের মাধ্যমে শিল্প ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আবাসন খাতের বিকাশ, অবকাঠামো উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে খাতটি। লিজ ফাইন্যান্স, কমার্শিয়াল পেপার, সিকিউরিটাইজেশনসহ আধুনিক আর্থিক সেবা উদ্ভাবনের পাশাপাশি পুঁজিবাজারকে প্রাণোদীপ্ত রাখার দায়িত্বও পালন করছে এ খাত। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রত্যাশা অনুযায়ী এনবিএফআই খাতের বিকাশ হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। বিশেষ করে বেশ কয়েকটি আর্থিক কেলেঙ্কারির পরে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে খাতটির ইমেজ সংকট দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের বেশ বৈচিত্র্যময় সেবা প্রদানের মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এমনকি সেখানে একক পণ্যভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও বেশ বড় কলেবরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আমাদের দেশেও সংখ্যায় কম হলেও কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে শুরু করেছে। প্রথম আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স ক্রেডিট কার্ড প্রচলন করেছে। এসএমই খাতে অর্থায়নের ক্ষেত্রে আইডিএলসি ফাইন্যান্স ও আইপিডিসি ফাইন্যান্স বেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ডিবিএইচ ফাইন্যান্স ও ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স দেশের আবাসন খাতে অর্থায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ফাইন্যান্স, অ্যালায়েন্স ফাইন্যান্স, অগ্রণী এসএমই ফাইন্যান্সিং কোম্পানি লিমিটেড ও আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল রেটিং অর্জন করেছে। শরিয়াহভিত্তিক আর্থিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে ইসলামী ফাইন্যান্স গ্রাহকদের শরিয়াহভিত্তিক আর্থিক পণ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য কাজ করছে। সম্প্রতি আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান শরিয়াহভিত্তিক কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে শরিয়াহভিত্তিক আর্থিক পণ্যের চাহিদা পূরণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ আরো বাড়বে।
এনবিএফআইগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) প্রেসিডেন্ট এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (আইআইডিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের শিল্প, ব্যবসা ও আবাসন খাতের উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছে। যখন সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছিল বিএসবি, শিল্প ব্যাংক যখন আমাদের শিল্পায়নের চাহিদা মেটাতে পারছিল না, তখন কিন্তু বেসরকারি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়েছে। মাঝে করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমরা কিছু সমস্যায় ছিলাম। সেগুলো ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছি। আমাদের যারা গ্রাহক আছেন, আমি তাদের বলব, আপনারা হতাশ হওয়ার কিছু নেই। যতজনের এখানে আমানত আছে তারা সবাই ফেরত পাবেন। সামনে আমরা পুরো উদ্যমে কাজ করতে পারব। আপনারা সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন, আমি আশা করি ২০২৪ সালের মধ্যেই আপনাদের যত রকমের চাহিদা আছে সেটি আমরা পূরণ করতে পারব।’
দেশের মোট ৩৫টি এনবিএফআইয়ের মধ্যে পাঁচটি জনগণের কাছ থেকে কোনো আমানত সংগ্রহ করে না। সরকারি খাতের তিনটির পাশাপাশি বিদেশী দুটি এনবিএফআইও এ তালিকায় রয়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে এনবিএফআইগুলোতে জমাকৃত মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। একই সময়ে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণকৃত ঋণ স্থিতির পরিমাণ ছিল ৭১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এনবিএফআইগুলোর ঋণগ্রহীতার সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার ৩৯২। এ বছরের মার্চ শেষে এ সংখ্যা ২ লাখ ৩৪ হাজার ৮৫-এ উন্নীত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা ও জরিপের ফলাফল বলছে, সারা বিশ্বে ব্যাংকের তুলনায় অর্থনীতিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ শক্তিশালী হচ্ছে। গত শতাব্দীর আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকের জামানতবিহীন ঋণের হার ছিল ৩০ শতাংশ। বর্তমানে এ হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বাজারভিত্তিক অর্থায়ন, বন্ড ও কমার্শিয়াল পেপারের মাধ্যমে এ বাজার দখলে নিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট ঋণের ৬৫ শতাংশই এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ব্যাংকের ভূমিকা আরো দুর্বল হয়েছে। দেশটির ৮০ শতাংশ করপোরেট ও বিদেশী বন্ডের মালিকানা চলে গেছে মিউচুয়াল ফান্ড, বীমা কোম্পানি এবং পেনশন তহবিলগুলোর হাতে। একইভাবে ব্যাংকের ভূমিকা দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিমত্তা বাড়ছে ইউরোপেও।