Home জাতীয় মানব স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের উপর বায়ু দূষণের এর প্রভাব অধ্যাপক ড....

মানব স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের উপর বায়ু দূষণের এর প্রভাব অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন পরিবেশ গবেষক ও সাবেক মহাপরিচালক, নায়েম।

39
0
SHARE

বায়ু দূষণ একটি বৈশ্বিক পরিবেশগত সংকট যা মানব স্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের ভারসাম্যের উপর গুরুতর প্রভাব ফেলছে। কলকারখানা, যানবাহনের ধোঁয়া, কৃষিকাজ, ধূলিঝড়, আবর্জনা পোড়ানো, জীবাশ্ম জ্বালানি ইত্যাদির ফলে বায়ু দূষণ সংগঠিত হয়। গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ বায়ুদূষণজনিত কারণে অকালমৃত্যুর শিকার হয়। টেকসই উন্নয়ন ও মানবকল্যাণের অন্যতম প্রধান শর্ত দূষণমুক্ত বায়ু। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকে শিল্পায়ন ও নগরায়নের কারণে বায়ু দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO, ২০১৮) অনুযায়ী, পৃথিবীর প্রায় ৯১% মানুষ দূষিত বায়ু শ্বাস হিসেবে গ্রহন করছে। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর (২০২২) এর তথ্যানুযায়ী, ঢাকার বায়ু মান সূচক (AQI) প্রায়শই ১৫০-এর উপরে থাকে, যা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে গণ্য।

আমাদের দেশে বিভিন্নভাবে বায়ুদূষণ সংঘঠিত হয়ে থাকে যেমন- শিল্প কারখানাগুলো থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড (CO), সালফার ডাইঅক্সাইড (SO₂), নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOₓ) এবং অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস বায়ুকে দূষিত করে। ভারী শিল্প ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। বিশ্বব্যাপী শিল্প কার্যক্রম থেকে প্রায় ২৫% বায়ুদূষণ সৃষ্টি হয় (UNEP, ২০২১)। শহরাঞ্চলে বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস হলো মোটরযানের ধোঁয়া। ডিজেল ও অকটেন চালিত গাড়ি থেকে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা (PM2.5 ও PM10) বায়ু দুষণ ঘটায় যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর।

বাংলাদেশে প্রায় ৪০% পরিবার এখনো কঠিন জ্বালানি (কাঠ, কয়লা, ফসলের অবশিষ্টাংশ) ব্যবহার করে রান্না করে, যার ফলে ঘরের অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ ঘটে (World Bank, ২০২০)। গ্রামীণ ও শহুর এলাকায় রান্না বা তাপ উৎপাদনের জন্য কয়লা, কাঠ, ফসলের অবশিষ্টাংশ এবং কেরোসিন ব্যবহারে প্রচুর ধোঁয়া তৈরি হয়, যা ঘরের অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণকে তীব্রতর করে তোলে।

কৃষি জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক, সার ও আগাছানাশক ব্যবহারের ফলে বিষাক্ত গ্যাস বায়ুতে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানোর কারণে বায়ু দুষণ ঘটে। ধূলি ঝড়, বনভূমিতে আগুন লাগা, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ইত্যাদিও বায়ু দূষণের প্রাকৃতিক উৎস। যদিও এগুলো মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তবে মানবসৃষ্ট দূষণের সাথে মিলিত হয়ে এর ক্ষতিকর প্রভাব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

মানবস্বাস্থ্যের বায়ুদূষণের প্রভাব বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে- বায়ুতে ভাসমান সূক্ষ্ম কণিকা (PM2.5, PM10) ফুসফুসে প্রবেশ করে অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া এবং ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD) সৃষ্টি করে। WHO (২০২১) অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ৪৩% COPD বায়ুদূষণ সম্পর্কিত। বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত কারণে প্রতি বছর আনুমানিক ১,২২,০০০ মানুষ মারা যায় (IHME, ২০২০)।

দূষিত বায়ুর কার্বন মনোক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইড রক্তে অক্সিজেন সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। PM2.5 এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগের ঝুঁকি ২০–২৫% বৃদ্ধি করে (Lancet, ২০১৯)। দীর্ঘমেয়াদি বায়ু দূষণের কারণে ফুসফুসের ক্যানসারসহ বিভিন্ন প্রকারের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। WHO বায়ু দূষণকে গ্রুপ-১ কার্সিনোজেন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দীর্ঘ সময় দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি ১৭% বৃদ্ধি পায় (IARC, ২০১৬)।

গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শরীরে দূষিত বায়ুর প্রভাব ভ্রূণের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। শিশুদের মধ্যে স্নায়ুবিক সমস্যা, কম জন্ম ওজন এবং শ্বাসকষ্টের প্রবণতা বেড়ে যায়। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩৭,০০০ নবজাতক অকালমৃত্যুর শিকার হয় (UNICEF, ২০১৯)। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ সময় দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে উদ্বেগ, ডিপ্রেশন ও স্নায়বিক দুর্বলতা বৃদ্ধি পায়।

বায়ুদূষণ জীববৈচিত্র্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে- বায়ুদূষণজনিত অ্যাসিড বৃষ্টি মাটির উর্বরতা কমায় এবং কৃষিজ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অ্যাসিড বৃষ্টি উদ্ভিদের পাতা, ফুল ও ফলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। SO₂ ও ওজোন উদ্ভিদের আলোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, ফলে কৃষি উৎপাদন কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, সালফার ডাইঅক্সাইডের উচ্চমাত্রা ধান ও গমের ফলন ১০–১৫% হ্রাস করতে পারে (FAO, ২০১৯)।

দূষিত বায়ুতে থাকা ভারী ধাতু (যেমন- সীসা ও পারদ) ও রাসায়নিক পদার্থ পানি ও মাটিতে জমা হয়, যা প্রাণীদের খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে। এতে মাছ, পাখি ও স্তন্যপায়ীরা ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে ধাবিত হয়। বায়ু দূষণের কারণে ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হলে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে বেশি পরিমাণে প্রবেশ করে। পাখি ও কীটপতঙ্গের প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যাহত করে। এটি প্রাণিজগত ও পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্য হুমকিস্বরুপ। অ্যাসিড বৃষ্টির কারণে হ্রদ, নদী ও জলাশয়ের pH মান পরিবর্তিত হয়ে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীকে বিলুপ্তির পথে ধাবীত করে।

বায়ু দূষণ মানবসভ্যতার জন্য এক নীরব ঘাতক। এটি একইসাথে স্বাস্থ্যঝুঁকি, অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে শিল্প কারখানায় নির্গমন নিয়ন্ত্রণ, যানবাহনে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার, সবুজায়ন বৃদ্ধি এবং পরিবেশবান্ধব জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। তাছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। টেকসই উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

image_pdfimage_print