
পুত্রকাণ্ডে মহাবিপদে পড়ছেন পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগের এমপি হাজী সেলিমসহ পুরো পরিবার। নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় সেলিমপুত্র ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বরখাস্তকৃত কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইরফান সেলিম গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওই পরিবারের অবৈধ সম্পদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। ইরফান ও বডিগার্ড জাহিদকে তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
এছাড়া বরখাস্তকৃত কাউন্সিলর ইরফানের বিরুদ্ধে চার মামলা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এদিকে পুত্রকাণ্ডের পর এখন বুড়িগঙ্গা দখল, খাসজমি দখল, টর্চার সেল, খুনের চেষ্টা, নির্যাতন, চুরি ও দুর্নীতির অভিযোগে হাজী সেলিমও ফেঁসে যাচ্ছেন বলে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের সূত্র থেকে জানা গেছে। হাজী সেলিমকে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা নিয়েও গুঞ্জন চলছে। আ.লীগ হাই-কমান্ডের কেউ হাজী সেলিমের ফোন রিসিভ করছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হাজী সেলিম পরিবার। অন্যায়-অনিয়মের পথ ধরেই উত্থান হয়েছে হাজী সেলিমের। রাজনীতিকে হাতিয়ার বানিয়ে চলছে একের পর ক্ষমতার অপব্যবহার— বুড়িগঙ্গা দখল, খাসজমি দখল ও সাধারণ মানুষের জমি দখল করা হয়েছে দীর্ঘ সময়।
র্যাবের ভাষ্যমতে, পুরান ঢাকার সবচেয়ে বড় ভবন আশিক টাওয়ার ভবনের ছাদে ছিলো ইরফান সেলিমের টর্চার সেল! সেখানে পাওয়া যায় মানুষের হাড়, উদ্ধার করা হয় হ্যান্ডকাফ, দড়ি, চাকুসহ নানা সামগ্রী। এছাড়া সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের বাড়ির পাশে চকবাজারে আরও একটি টর্চার সেল রয়েছে বলেও র্যাবের দাবি।
রাজধানীর চকবাজারের দেবীদাস ঘাট লেনে হাজী সেলিমের বাসায় অভিযান চালিয়েও ‘টর্চার সেল’-এর সন্ধ্যান মিলেছে দুটি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, মদ, হাতকড়া, (ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার) যন্ত্র, ৩৮টি ওয়াকিটকি, দেহরক্ষীর কাছ থেকে ৪০০ পিস ইয়াবা এবং ড্রোনসহ বিভিন্ন ডিভাইস।
১৯৯৬ সালে তৎকালীন অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার হাজী সেলিম জাতীয় নির্বাচনে এমপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিজ দল বিএনপি তাকে মনোনয়ন না দেয়ায় যোগ দেন আওয়ামী লীগে। আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দিলে তিনি এমপি নির্বাচিত হন।
তবে ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে যান বিএনপি প্রার্থী নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুর কাছে। মূলত ওয়ার্ড কমিশনার থাকার সময় থেকেই রাজধানীর লালবাগ, চকবাজারসহ পুরান ঢাকার একটি বড় অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন হাজী মোহাম্মদ সেলিম।
অভিযোগ রয়েছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি হল দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেছেন তিনি। আর এমপি হওয়ার পর রীতিমতো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। স্থানীয়দের অভিযোগ, ক্যাডার বাহিনী গঠন করে এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতেন বিতর্কিত এই জনপ্রতিনিধি।
বিএনপি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে অন্তত ১২০টি মামলা করা হয় হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে। খুন, খুনের চেষ্টা, নির্যাতন, চুরি এবং দুর্নীতি ও অবৈধ আয়ের কারণে এসব মামলা করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে একজন পুলিশ অফিসারকে লাঞ্ছিত করেন হাজী সেলিম। ওই সময় তার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা হয়। ওয়ান-ইলেভেন আসার সাথে সাথে পালিয়ে দেশ ত্যাগ করেন সন্ত্রাসের বরপুত্র। নির্বাচনের আগে যখন দেশে ফেরেন তখন তার মাথায় দুইশ মামলা।
এরপর নাটকীয়ভাবে এসব মামলা প্রত্যাহার হয়। প্রথম দফায় ‘হয়রানিমূলক’ চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে করা ২১টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ২০০৯ সালের ২৫ মে হাজী সেলিম আবদুল হান্নান হত্যামামলা থেকে খালাস পান।
২০০১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর হাজী সেলিম রেকর্ড করেন। তার বিরুদ্ধে করা ১০৫টি মামলা একযোগে প্রত্যাহার করা হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২ সালে পুলিশের ওপর আক্রমণের মামলাটিও প্রত্যাহার করা হয়।
২০১৪ সালেও মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা করেন হাজী সেলিম। সে মামলাও থমকে গেছে। ওই বছরই বুড়িগঙ্গা অবৈধ দখলদারমুক্ত করার অভিযানেও আদালত অবমাননা করেন হাজী সেলিম।
গতকাল বুধবার দুপুরে দুদক প্রধান কার্যালয়ে কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানান, সংসদ সদস্য হাজী সেলিম ও তার ছেলে ইরফান সেলিমের অবৈধ সম্পদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এসব যদি দুদক আইনে তফসিলভুক্ত হয় তাহলে তা নিয়ে অনুসন্ধান করা হবে।
‘অবৈধ সম্পদের বিষয়গুলো যদি দুদকের শিডিউলের সাথে সম্পর্কিত হয় এবং শিডিউলভুক্ত অপরাধের শামিল হয় তাহলে আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবো এবং দুদকের আইনে পরে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
কমিশনার মোজাম্মেল বলেন, সরকারের জায়গা বা সম্পত্তি হোক, যদি দখল হয় তাহলে দুদক আইনের আওতাভুক্ত হলে সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বরখাস্তকৃত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে গতকাল অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা করেছে র্যাব।
ইরফানের দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদের বিরুদ্ধেও পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। গত সোমবার পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাটের দেবীদাস লেনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ইরফান ও জাহিদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের পর সোমবার হাজী সেলিমের বাড়ি তল্লাশি করে মদ ও ওয়াকিটকি পাওয়ায় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ইরফান ও জাহিদকে এক বছর করে কারাদণ্ড দেন।
গত রোববার নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট মো. ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধরের পর তিনি ধানমন্ডি থানায় ইরফান ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
ওই মামলায় গতকার এক শুনানি শেষে ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদকে তিন দিনের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে ঢাকার হাকিম আদালত।
এছাড়া ইরফান ও জাহিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক মামলায় সাত দিন করে মোট ১৪ দিনের রিমান্ডে চেয়ে আবেদন করা হবে বলে চকবাজার থানার ওসি মওদুত হাওলাদার জানিয়েছেন।
এদিকে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম ও তার সহযোগী জাহিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে পৃথক দুটি করে মোট চারটি মামলা তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গতকাল অস্ত্র আইনে দুইটি মামলায় এজাহার আদালতের পৌঁছালে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরী তা গ্রহণ করে আগামী ১৭ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
একই সঙ্গে ইরফান ও জাহিদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলায় ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদের এজাহার গ্রহণ করে আগামী ৩ ডিসেম্বর তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
মঙ্গলবার দিবাগত রাতে চকবাজার থানায় র্যাবের পক্ষ থেকে এসব মামলা করা হয়। চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুত হাওলাদার এ তথ্য জানান।
গত মঙ্গলবার বিকেলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের কাজে ওয়াকিটকি ব্যবহার করতো ইরফান।
ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতো সে। তার বাড়ি থেকে বিদেশি মদসহ অন্য মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় র্যাব বাদি হয়ে দুটি দুটি করে মোট চারটি মামলা করেছে।