
নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মালিকানাধীন ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ এ অবৈধভাবে গড়ে ওঠা দোকানপাট উচ্ছেদে কর্তৃপক্ষের অভিযান দোকানিদের বাধার কারণে গতকাল যথাসময়ে শুরু করা সম্ভব হয়নি। পরে অভিযান দলের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য যুক্ত করা হয়। এর পর অভিযান শুরু হলে পুলিশ ও ডিএসসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হামলা চালান দোকানিরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শেষ পর্যন্ত পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের পাশাপাশি লাঠিপেটাও করে। অভিযানে বাধা প্রদানকারীরা বলছেন, তারা দোকান কেনার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছেন। এর পর সেগুলোর বৈধতা পেতেও দফায় দফায় টাকা ঢেলে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খোয়ানোর পর এখন শেষ সম্বল যে দোকান, তাও খোয়ালে কীভাবে বাঁচবেন? ভুক্তভোগী এসব দোকানি বলছেন, তারা সব হারালেও পর্দার আড়ালে থাকা নাটের গুরুরা অধরাই থেকে যাচ্ছেন। তাদের কেন ধরা হচ্ছে না, যাদের জন্য আজ দোকান কিনেও এত ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে? উচ্ছেদ অভিযানের মুখে সব হারাতে হচ্ছে?
গতকাল বেলা পৌনে ২টা থেকে শুরু হওয়া ডিএসসিসির এ উচ্ছেদ অভিযান আরও কয়েক দিন চলবে বলে জানা গেছে। গতকাল সকাল ১১টা থেকে এটি শুরু হওয়ার কথা ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীসহ ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট ২-এর এ, বি ও সি ব্লকে (সিটি প্লাজা, নগর প্লাজা ও জাকের প্লাজা) অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ৯১১টি দোকান চিহ্নিত করার পর সেগুলো উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিন দিন আগে নোটিশ দেওয়া হয় এবং মাইকিং করা হয়। সে অনুযায়ী গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে ওই মার্কেটে যান সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এতে নেতৃত্ব দেন করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মুনিরুজ্জামান, ইরফান উদ্দিন আহমেদ ও তানজিলা কবির ত্রপা। তবে ব্যবসায়ীরা মার্কেটের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করলে অভিযান শুরু করতে বিলম্ব হয়। মার্কেটের সামনে অবস্থান নিয়ে দোকানিরা সেøাগান দিতে থাকেনÑ অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন, সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন, মালিক সমিতির বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন, ‘রক্ত লাগলে রক্ত দেব, দোকান ছাড়ব না’, ‘রক্ত লাগলে রক্ত দেব, রাজপথ ছাড়ব না’।
এমন অবস্থায় বেলা পৌনে ১টার দিকে এক্সকাভেটর দিয়ে মার্কেটের নগর প্লাজার সামনের ফুটপাতে গড়ে ওঠা একটি দোকান ভাঙা শুরু করে করপোরেশন। এতে ব্যাপক উত্তেজিত হয়ে পড়েন দোকানিরা। তারা চারপাশ থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। শুরুতে পুলিশ কিছুটা পিছু হটে। কিছুক্ষণ পর কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ও টিয়ারশেল ছোড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। এ সময় পুরো এলাকাজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, যা পুরো দিনই বিরাজ করছিল। এদিন ফুলবাড়িয়া সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচলও বন্ধ রাখা হয়।
গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা অভিযানে প্রায় আড়াইশ দোকান উচ্ছেদ করা হয়। করপোরেশনের হিসাবে অবৈধ দোকানের সংখ্যা ৯১১টি বলা হলেও কর্মকর্তারা বলছেন, এ সংখ্যা অন্তত ১৫০০। অবৈধ সব দোকান উচ্ছেদ করতে আরও কয়েক দিন লাগতে পারে।
এদিকে দোকানিদের দাবি, ডিএসসিসির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের সময় নকশাবহির্ভূত এসব দোকান বৈধ করতে তারা লাখ লাখ টাকা দিয়েছেন। দোকানগুলো থেকে ডিএসসিসি এত দিন ভাড়াও নিয়েছে। এখন কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই দোকান উচ্ছেদ করছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে মার্কেটটির নিয়ন্ত্রণ ছিল মালিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলুর হাতে। তিনিই দোকানিদের কাছে এসব দোকান বিক্রি করেছেন। পরবর্তী সময়ে দোকান স্থায়ী বরাদ্দ প্রদানের কথা বলেও দফায় দফায় টাকা নিয়েছেন। মার্কেট মালিক সমিতির কয়েক সদস্য এবং স্থানীয় যুবলীগ নেতা বাপ্পীর মাধ্যমে গত বছরও দোকানভেদে ৮ থেকে ১৫ লাখ টাকা তোলা হয়েছে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত।
গতকাল উচ্ছেদ শুরু হওয়ার পর মার্কেটটির আশপাশে অবৈধ দোকানগুলোর মালিকদের কান্না করতে দেখা যায়। তারা অনেকেই বলছেন, দোকানগুলো সিটি করপোরেশনের অনুমোদিত জেনেই তারা ক্রয় করেছেন। কিন্তু এখন দোকানগুলো ভেঙে ফেলা হয়। এতে তারা সর্বস্ব খুইয়েছেন। ধারদেনা করে শীতের কাপড় তুললেও এখন রাস্তায় দাঁড়াতে হচ্ছে।
মনিরুল ইসলাম, মো. আতাউল্লাহ, শরফরাজ হোসেনসহ অনেকের সঙ্গেই কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাদের অভিযোগÑ ভুল তথ্যের মাধ্যমে আমাদের কাছে দোকান বিক্রি করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বৈধতার কথা বলেও লাখ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যারা এসবের ক্রীড়নক, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল। আমরা সব হারিয়ে রাস্তায় নেমে গেলাম!
মো. আতাউল্লাহ বলেন, দোকান ক্রয় করতে পনের লাখ টাকা দিয়েছি। এর পর বৈধতার কথা বলে ১০ লাখ টাকা নিয়েছে গত বছর। বিদেশে থাকাকালীন জমানো টাকায় এ দোকানটি কিনেছিলাম। কিন্তু এখন সব হারিয়ে পথে বসতে হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) মার্কেট ফেডারেশনের সভাপতি ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেন, আমরা ডিএসসিসির মেয়রের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আশ্বস্ত করেছেন ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবেন।
ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগ জানায়, মার্কেটটির নকশা অনুয়ায়ী এ ব্লকে ১৭৬টি দোকান, বি ব্লকে ১৭৬, সি ব্লকে ১৭৯টিসহ ৫৩১টি দোকান থাকার কথা। কিন্তু নকশাবহির্ভূতভাবে এ ব্লকে ৩০৮টি, বি ব্লকে ২৯২ এবং সি ব্লকে ৩১১টি দোকান করা হয়েছে।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটির নতুন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব নেওয়ার পর এ বিপণিবিতানের নকশাবহির্ভূত দোকান এবং এর সার্বিক পরিস্থিতি জানতে একটি কমিটি গঠন করে দেন। করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের এ কমিটি বিপণিবিতানে নকশাবহির্ভূত ৯১১টি দোকান চিহ্নিত করে এবং সেগুলো উচ্ছেদের সুপারিশ করে। কমিটির সুপারিশে মেয়রও সম্মতি দেন।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মুনিরুজ্জামান বলেন, মার্কেটটিতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সব দোকান ভাঙা হবে।
প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব দোকান ভাঙার বিষয়ে আগেই নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। আমরা পর্যায়ক্রমে সব অবৈধ দোকান ভাঙব।