
হকাররা বিভিন্ন রকম বাচনভঙ্গীর মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানীর প্রচার, প্রসার এবং নিজের রুটি রুজির ব্যবস্থা করে থাকেন। একজন খেলনা বিক্রেতা হকারের নিম্নোক্ত উক্তিটি আমাকে এই লেখায় অনু-প্রাণীত করেছেঃ
“আপনার বাচ্চা খেললে
আমার বাচ্চা খেতে পারবে।”
তিনি হয়তো তার মনের অগোচরে অত্যন্ত মূল্যবান এবং যুক্তপূর্ণ একটি বাক্য উচ্চারণ করেছেন যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। যা যে কোন ব্যবসার বিক্রয় বৃদ্ধির প্রচার কৌশল বা পরিকল্পনা হতে পারে।
একজন অশিক্ষিত বা অর্ধ-শিক্ষিত হকার কেমন করে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল রপ্ত করলেন তা ভেবে দেখা দরকার। একটি মাত্র উক্তি যা যে কোন বয়সের মানুষের মনকে আন্দোলিত করে।
আসলে শিক্ষিত অশিক্ষিত বলে ব্যবসার ক্ষেত্রে কিছু নেই। এই ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গী বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আামাদের দেশের অনেক বড় বড় কোম্পানীর মালিকই অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত কিন্তু সন্তানদের দেশ বিদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষিত করে এনে ব্যবসা দেখাশুনা করাচ্ছেন। নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দশের ও দেশের সেবায় ব্রত রয়েছেন। কর্মীদের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য ও কর্মস্পৃহা জাগ্রত করে প্রতিষ্ঠানের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়ার সময় পরিকল্পনা ও অনুসঙ্গ এবং কৌশলগত অনেক কিছুই জেনেছি এবং শিখেছি। যা নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের দ্বারা তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছি। একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পরিকল্পনা একটি গরুত্বপূর্ণ বিষয়, তার পাশাপাশি কর্মীদের মোটিভেট করাও বিশেষভাবে জরুরী। তাছাড়া যিনি ব্যবসা পরিচালনা করবেন তাঁর সকল কাজের উপর বিশেষ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ বলয় থাকতে হবে। তার মানে একজন ব্যবসায়ীকে বা ব্যবসা পরিচালনাকারীকে তাঁর ব্যবসার জন্য চৌকষ অর্থাৎ সবজান্তা শমসের হতে হবে।
আমার জন্মের সাল অর্থাৎ ১৯৬০ সাল থেকে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি বিষয় নতুন সংযোজিত হয়েছে, তা হলো ষ্ট্র্যাটিজিক প্লানিং। যা সাধারণতঃ সমরবিদ্রা অর্থাৎ যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী ব্যবহার করে থাকেন। শত্রু আক্রমনে তাঁরা একের অধিক পরিকল্পনার মাধ্যমে অগ্রসর হন। একটি পরিকল্পনা নৎসাৎ হলেও যেন আরো একটি বা একাধিক পরিকল্পনা ব্যবহার করে কার্য হাসিল করা যায়। তাই যে কোন সময় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরকে তাঁদের পরিকল্পনার বিকল্প হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন। এই বাহিনী যে কোন সময় বিকল্প রাস্তা, কালভার্ট, ব্রিজ নির্মাণের মাধ্যমে শত্রুকে ঘায়েল করতে মূল বাহিনীকে সহায়তা করতে পারেন।
ব্যবসা এখন অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ ও অসম প্রতিযোগীতাপূর্ণ। এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যবসাকে এগিয়ে নেয়া। পরিবর্তনশীল ও প্রতিযোগীতামূলক অবস্থানে থেকে সংগঠনকে সুনিপুন কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালনাই পরিকল্পনার আসল উদ্দেশ্য। কোম্পানীতে কর্মরত কর্মীদের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আধুনিক পরিকল্পনা হলো SWOT বিশ্লেষণ। যা যে কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মীদের কর্মশক্তি বা Strength, দুর্বলতা বা Weakness, সুযোগ বা Opportunity, ভীতি বা threat গুলো চিহ্নিত করণে সহায়তা করে।
সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া কোন কাজেই সফলতা আসে না, একমাত্র এর মাধ্যমেই ঈস্পিত লক্ষ্য অর্জন করা যায়। পরিকল্পনা দিক নির্দেশনা দেয়, পরিবর্তিত অবস্থা মোকাবেলা করতে সাহস যোগায়, কার্য সম্পাদনের সমন্বয়ে সহযোগীতা করে, মিতব্যয়িতা অর্জনে সহায়তা করে, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে, তাছাড়া সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে যা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্য, উন্নতিও সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত।
বর্তমান পরিবেশ এবং পরিবর্তিত পরিবেশ এর উপর তীক্ষè দৃষ্টি রেখেই ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা তৈরী করা হয়। কোম্পানীর সম্পদ ও সামর্থ্যকে পরিবর্তিত অবস্থায় ফিট রাখার জন্য সামরিক বাহিনীর অভিধান থেকে কৌশলগত বা ষ্ট্র্যাটিজিক শব্দটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ধার করা হয়েছে। সামরিক বাহিনীর সকল পরিকল্পনাই কৌশলগত পরিকল্পনা। পরিবেশের বর্ণনা কৌশলগত পরিকল্পনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিদ্যমান পরিবেশে ভবিষ্যতে কি কি পরিবর্তন হতে পারে এবং সেই পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে করণীয় কি হতে পারে সেখানে তার বর্ণনাও থাকে। সে কারণে ষ্ট্র্যাটিজিক বা কৌশলগত পরিকল্পনা কখনো ব্যর্থ হতে দেখা যায় না।
২০১৯ সালে এক গবেষণায় প্রায় নয় হাজার সরকারী ও বেসরকারী সংগঠনের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় কৌশলগত পরিকল্পনা সংগঠনের কর্মসাধনের উপরে ইতিবাচক প্রভাব রাখে। কৌশলগত পরিকল্পনা সফল করতে হলে এটিতে কিছু আনুষ্ঠানিকতা অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ পরিবেশের বিশ্লেষণ ও ঐ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কৌশল, লক্ষ্য, পরিকল্পনা নির্ধারণ, সর্বাঙ্গীন সমন্বয় অর্থাৎ অনেকগুলো কৌশল থেকে একটি পথ বাহির করা এবং সতর্কতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ কৌশলগত পরিকল্পনা প্রক্রিয়ার ধাপে ধাপে কাকে কাকে, কেন, কখন ও কিভাবে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে সে ব্যাপারে দিক নির্দেশনা থাকতে হবে। এটা সব সময় কম্পিউটার কম্পোজ করা স্পাইরাল বাইন্ডিং হতে হবে এমন কথা নেই। মনে মনেও পরিকল্পনা করা যেতে পারে এবং তা বাস্তবায়নই আসল কথা। কারণ একটি ভালো পরিকল্পনা কাজের অর্ধেক সফলতা আনে। পরিকল্পনা প্রনয়ণ একটি সৃজনশীল কাজ। আমরা কোথায় আছি এবং কোথায় যেতে চাই এই দু’য়ের মধ্যে সেতু বন্ধন হলো পরিকল্পনা।
বীমা শিল্পের জন্য যুঁৎসই পরিকল্পনা হলো স্থান, অঞ্চল, ভৌগলিক সীমানা নির্ধারণ করে এলাকা ভিত্তিক টার্গেট ওরিয়েনটেড পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, বরিশাল কিংবা ফরিদপুর, যশোর কিংবা নরসিংদী ইত্যাদি এলাকার ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা এবং মন-মানসিকতা এক নহে। আঞ্চলিকতার কারণে খরচেরও তারতম্য হতে পারে তা মাথায় নিয়েই পরিকল্পনা তৈরী করতে হবে।
রংপুর বা দিনাজপুরকে ঢাকা বা চট্টগ্রামের সমকক্ষ ভেবে পরিকল্পনা করলে তা ভেস্তে যাবে। কারণ ঐ সকল অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যের ধরণে পার্থক্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে মানুষের মধ্যে আয়ের বৈষম্য। রয়েছে জীবন যাত্রার মানের তারতম্য। তাই স্থানভেদে নীতি, প্রক্রিয়া, পদ্ধতি, রীতি ও কৌশল পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই তাদের পরিকল্পনা মাফিক চলে। পরিকল্পনার কারণে কাজ অনেকটা সহজ হয় এবং চলার পথে কখনো কখনো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে পরিকল্পনার অবস্থানগত ও সিদ্ধান্তগত পরির্বতন আনা সহজ হয়। সংগঠনের ভিতর কর্মরত কর্মীদের দ্বারাই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হয়। তাই সাংগাঠনিক অবস্থান দৃঢ় করার জন্য কর্মীদের ট্রেনিং, প্রেষনা, যোগ্য লোকের মূল্যায়ন, মোটিভেশন ইত্যাদি পরিকল্পনায় সন্নিবেশিত থাকতে হবে। কাজ এবং কাজের পারিশ্রমিক, কর্মীদের কাজে উদ্বুদ্ধকরণ এবং ব্যবস্থাপনার সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ কোম্পানীর সুনাম এবং উত্তোরত্তোর উন্নতির সোপান। পরিকল্পনা প্রনয়ণের সময় এই কথা ভুলে গেলে চলবে না।
অন্যান্য আর দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো বীমা কোম্পানীসমূহের জন্যও পরিকল্পনা জরুরী। তবে কলকারখানা বা উৎপাদনশীল ও শুধুমাত্র আমদানী রপ্তানী বা গুদামজাত ও মজুদ প্রতিষ্ঠানের মতো বীমা কোম্পানীর পরিকল্পনা তৈরী করলে চলবে না।
বীমা ব্যবসা লাইফ ও নন-লাইফ। প্রথমটি মানুষ ও তাঁর জীবন, সুস্থতা-অসুস্থতা, হাসপাতলে চিকিৎসা, অকস্মাৎ মৃত্যু, বা দূর্ঘটনাজনিত মৃত্যু এখন আবার ব্যাংকের মতো ডিপোজিট ও কিছু কিছু ঝুঁকি সমন্বয়ে বীমাপত্র প্রদান করা হয়ে থাকে। এই ব্যবসার বড় সমস্যা হলো মানুষের মধ্যে বীমা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং বীমা কর্মীদের শিক্ষার দৈন্যতা, পলিসি করার সময় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ না করা বিশেষ করে প্রুফ অব এজ অর্থাৎ জন্ম সনদ সার্টিফিকেট না নেয়া, প্রিমিয়াম প্রদানের সক্ষমতা যাচাই না করে পলিসি ইস্যু করা, পলিসি শুরুর পূর্বে বিভিন্ন শারিরীক পরীক্ষার জাল সার্টিফিকেটের মাধ্যমে বীমা পলিসি ইস্যু করা, বছর বছর পলিসি রিনিউ না হওয়া, ক্ষুদ্র বীমার প্রিমিয়াম ঠিকমতো জমা না হওয়া, কোম্পানীগুলোতে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম, দাবী পরিশোধে গড়িমসি, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও বীমার বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত নির্দেশনার অভাব, এই শিল্পের প্রসারের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। তাই পরিকল্পনা প্রনয়ণে এবং কৌশল প্রয়োগের ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।
নন-লাইফ বীমা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লোন নিলে বীমা বাধ্যতামূলক। অন্যান্য ক্ষেত্রে অর্থাৎ ব্যাংকের লোন না থাকলে ব্যক্তির ইচ্ছার উপর বীমা নির্ভর করে। তিনি যদি সত্যিকার ও বিচক্ষণ ব্যবসায়ী হন তবে তিনি তার সম্পদের আর্থিক নিরাপত্তা বিবেচনা করে বীমা করবেন এবং সুরক্ষিত থাকবেন। গ্রাহকরা অনেক ক্ষেত্রে শর্ট কাট বীমা করতে চান, তারা যা না হলেই নয় সেইটুকু ঝুঁকি নিতে আগ্রহী হন, তাই অনেক সময় দাবী সংক্রান্ত বিড়াম্বনায় পরেন। এতে বীমা কোম্পানীর সুনাম নষ্ট হয়, বীমা গ্রহীতা সত্যিকার অর্থেই ক্ষতিগ্রস্থ হন। বকেয়া প্রিমিয়াম নন-লাইফ বীমার অগ্রগতির পথে একটি বড় বাঁধা। এই সমস্যার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ) ও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে আলোচনা করে বীমা কভার নোট/পলিসি হাতে পাবার সাথে সাথে বীমা প্রিমিয়াম প্রদানের নির্দেশনা দিয়ে ব্যাংকগুলোতে একটি সার্কুলার ইস্যুর চেষ্টা করেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি যা প্রিমিয়াম বকেয়া থাকার অন্যতম কারণ। বীমা পত্রের বিপরীতে প্রিমিয়াম জমা না হওয়া বীমা দাবী নিষ্পত্তির অন্যতম অন্তরায়। যা থেকে উত্তোরণের পন্থা বের করা জরুরী। কমিশন বাণিজ্যও একটি মারাত্মক রোগ। যা নন-লাইফ বীমা ব্যবসাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
লাইফ এবং নন-লাইফ বীমার ব্যবসা নির্ভর করে সার্ভিসের উপর। দক্ষ ও নির্ভরশীল সেবা বীমা ব্যবসার মূলমন্ত্র। এই সেবা বীমা কর্মী বা এজেন্ট, কোম্পানী সরাসরি এবং ব্রোকারেজ কোম্পানী (যা আমাদের দেশে চালু হওয়ার প্রক্রিয়ায়), ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। পরিকল্পনার কৌশল নির্ধারণে এদের সংপৃক্ততার কথা মাথায় রাখতে হবে।
লেখকঃ মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ
মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড।