Home ব্রেকিং স্বপ্নদ্রষ্টার জন্ম, বাঙালির মুক্তি- ড. মো. আবু তাহের

স্বপ্নদ্রষ্টার জন্ম, বাঙালির মুক্তি- ড. মো. আবু তাহের

248
0
SHARE

কালের সীমাবদ্ধতার কারণে স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেনি এটা সত্য। কিন্তু তাদের আরও বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা অবারিত রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, যেদিন এ দেশের প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান সুনিশ্চিত হবে, সবাই মন-প্রাণ খুলে বলবে, ভালো আছি, সুখে-শান্তিতে বসবাস করছি, সেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণ সার্থক ও অর্থবহ হবে। এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

গভীর ভালোবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি বাঙালি জাতির মহান শিক্ষক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ দিনটি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল দিন। কেননা ওইদিন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নিয়েছিলেন এক শিশু, যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। মা-বাবা আদর করে ডাকতেন খোকা বলে।

সেদিন কে জানত এই খোকা একদিন বড় হয়ে স্বাধীন বাংলার মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধুরূপে আত্মপ্রকাশ সর্বোপরি জাতির পিতা ও পরবর্তীতে বিশ্ববন্ধুতে রূপান্তরিত হবেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪১ সালে রচিত ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধের উপসংহারে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন, ‘পরিত্রাণ কর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্য লাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে। মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে শোনাবে এই পূর্ব দিগন্ত থেকেই।’

কবিগুরুর এই ভবিষ্যদ্বাণী যথাযথ প্রমাণিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে, যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সকলের ঐক্যবদ্ধতায় সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাস্ত করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে একটি স্বাধীন জাতি ও ভাষারাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল গ্রামের স্কুলে। শৈশবকালও কেটেছে গ্রামে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা এবং সামাজিক দুস্থ মানবতার সেবামূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন টুঙ্গিপাড়া, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জে।

১৯৪২ সালে কলকাতা ইসলামী কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। ওই কলেজ থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। আইন শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ছাত্রত্ব বাতিল করে। উল্লেখ্য, রাজনীতি মনস্ক শেখ মুজিব স্কুল জীবনে শেরে বাংলা  একেএম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী এবং পরবর্তীতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সান্নিধ্যে আসেন, যা পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর জীবনাচরণে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির সাত মাসের মাথায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু কারাবরণ করেন। তখনই তিনি উপলব্ধি করেন পাকিস্তানের এই অদ্ভুত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে আর যাই হোক বাঙালির স্বার্থ রক্ষিত হবে না। প্রয়োজন হবে বাঙালির অধিকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের। শুরু করেন ধারাবাহিক আন্দোলন ও সংগ্রাম এবং এতে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বছরের পর বছর কারাগারে মানবেতর জীবন কাটিয়েছেন।

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও অন্যায়ের কাছে, স্বাধীনতার প্রশ্নে কিংবা বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে কোনো দিন আপোস করেননি। তিনি আজীবন একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। যেখানে মানুষ দুই বেলা, দু’মুঠো ভাত খেয়ে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে, উন্নত জীবন পাবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, মানুষের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত হবে, দুর্নীতিমুক্ত, শোষণমুক্ত-বৈষম্যহীন ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম হবে।

তিনি বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। এ জাতির জন্য একটি স্বাধীন ভূখ- উপহার দিয়েছেন। জাতি হিসেবে বাঙালি বিশ্ব দরবারে মর্যাদা পেয়েছে। মূলত  বঙ্গবন্ধুর সাহসী ও কৌশলী নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

স্বাধীনতা-উত্তর বৈরী আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিবেশ ও অভ্যন্তরীণ সকল প্রতিকূল প্রকৃতিকে মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য শুরু করেন এক অবিস্মরণীয় সংগ্রাম। স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে জাতিকে উপহার দিলেন গণমুখী সংবিধান। এ সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্নগুলো বিধৃত হয়েছে। দেশের মানুষের প্রতি যে ভালোবাসা দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাপূর্বকালে সংগ্রাম করেছেন, ঠিক তেমনি ভালোবাসা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেছেন যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে।

অথচ যে দেশটির জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই দেশটিকে গড়ে তোলার সময়টুকুও তাঁকে দেওয়া হলো না। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে বঙ্গবন্ধুর রক্তে রঞ্জিত হলো এ দেশের মাটি। শুরু হয় সামরিক শাসন ও ছদ্মবেশী গণতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৯১ সালে দেশে যে গণতান্ত্রিক ধারা সূচিত হয়েছিল, ঘাত-প্রতিঘাত সত্ত্বেও তার ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত আছে।

তবে এ কথাও সত্য যে, বর্তমানে সমাজ ব্যবস্থায় যে সমস্ত আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, সিন্ডিকেট, মাদক, কালোবাজারি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজিসহ সামাজিক অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে, তা দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিচক্ষণতার সঙ্গে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে। শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অসমসাহসে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির এ সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে।

এতেই দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে, মাথাপিছু আয় বাড়বে, উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ সত্যি সত্যিই বঙ্গবন্ধুর আরদ্ধ সাধনা সোনার বাংলায় পরিণত হবে।

বিশ্বায়ন ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে বর্তমান সরকারকে ভবিষ্যতে আরও অনেক অবিশ্বাস্য চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে  বাংলাদেশের উন্নয়নের বিরামহীন যে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে তা পৃথিবীর কোনো শক্তি আর থামাতে পারবে না। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। আশা করি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ রূপকল্প ২০৪১ যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবেই।

আমি আশাবাদী মানুষ। বর্তমানে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ অনেক উন্নয়নশীল দেশ থেকে এগিয়ে রয়েছে। তবে এ নিয়ে আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই। আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল হয়েছি, আরও সাফল্য চাই। প্রতিদিনই আমাদের সংগ্রাম চলছে। আর এ সংগ্রামে আমরা অবশ্যই জয়ী হব- এতে কোনো সন্দেহ নেই। অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ এবং পঙ্গু অর্থনীতিকে আমরা যেভাবে এ পর্যায়ে নিয়ে আসতে পেরেছি, সেখান থেকেই তো ভরসা পাই।

বর্তমানে বিশ্বে যারা শুভবাদের স্বপ্ন দেখেন, যারা মানবিকতার দৃঢ় প্রত্যেয়ে সত্যের সঠিক ইতিহাসের আলোয় সমগ্র জাতিকে উদ্ভাসিত করতে চান তাদের সকলের হৃদয়ে বিনম্র শ্রদ্ধায় বঙ্গবন্ধু চির জাগরূক থাকবে।

কালের সীমাবদ্ধতার কারণে স্বাধীনতাত্তর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেনি, এটা সত্য। কিন্তু তাদের আরও বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা অবারিত রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, যেদিন এ দেশের প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান সুনিশ্চিত হবে, সবাই মন-প্রাণ খুলে বলবে, ভালো আছি, সুখে-শান্তিতে বসবাস করছি, সেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণ সার্থক ও অর্থবহ হবে।

এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, সর্বোচ্চ সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে সম্পাদন করা। এটাই হোক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

image_pdfimage_print