
ডেস্ক: সুদীর্ঘ ৬৮ বছর বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ছিটমহলবাসীরা ছিল বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের বাসিন্দা। প্রায় ‘অবরুদ্ধ’ অবস্থায় লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত হয়ে কাটছিল তাদের জীবন। সেই হতভাগ্য জীবনে মুক্তির বারতা আসে ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই মধ্যরাতে। বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের আন্তরিকতায় তারা পায় নিজ দেশ, মাতৃভূমি, পতাকা, নাগরিকত্ব ও অধিকার। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল যুক্ত হয় বাংলাদেশে, আর ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল যুক্ত হয় ভারতের সঙ্গে। বাংলাদেশের মানচিত্রে স্থান পাওয়ার পর বিলুপ্ত হওয়া এসব ছিটমহলের বাসিন্দারা পাচ্ছে সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। নাগরিকত্ব পাওয়ার পর এরই মধ্যে তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। আর ৬৮ বছর পর এবার তারা প্রথমবারের মতো ভোট দেবে জাতীয় নির্বাচনেও। বিলুপ্ত ছিটমহল ঘুরে দেখা গেছে, নির্বাচন উপলক্ষে ছিটমহলগুলোতে লেগেছে বাড়তি আনন্দ-উৎসাহের আমেজ। নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রচার-প্রচারণায় মুখর বিলুপ্ত ছিটমহলের গ্রামগুলো।
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ১১১টি বিলুপ্ত ছিটমহলে এরই মধ্যে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। রাস্তাঘাটা পাকা হয়েছে, বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে প্রায় সব ঘরে। স্কুল-কলেজ নির্মিত হয়েছে, কমিউনিটি হাসপাতাল হয়েছে। বয়স্ক ও বিধবা ভাতাসহ বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী পাচ্ছে নানা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। এর বাইরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, স্যানিটেশন, সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় আসাসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে সেখানের মানুষগুলো। দীর্ঘদিন অন্ধকারে থেকে আলোর পথে ফিরে তাদের জীবনে এসেছে নতুনত্বের স্বাদ। ছিটমহলবাসী মনে করছে, সেটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার জন্যই। আর এ জন্যই বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নৌকার প্রতীকের প্রতি দেখা গেছে বিপুল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দইখাওয়া বাজার। এ বাজার থেকে খানিক এগোলেই দুটি পাশাপাশি বিলুপ্ত ছিটমলের অবস্থান। হাতীবান্ধার গোতামারী ইউনিয়নের উত্তর গোতামারী গ্রামে যুক্ত হয়েছে সেই ছিটমহল দুটি। হাতীবান্ধার ১৩৫ ও ১৩৬ নম্বর বিলুপ্ত ছিটমহল ঘুরে দেখা গেছে, বিলুপ্ত ছিটমহল দুটিতে নির্মিত হয়েছে পাকা রাস্তা। বিদ্যুৎও পৌঁছে গেছে সেখানে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যারপরনাই খুশি বাসিন্দারা। এর মধ্যে বাড়তি আনন্দ নিয়ে এসেছে এবারের নির্বাচন। উত্তর গোতামারী গ্রামের বাসিন্দা আতাউর রহমান বলেন, ‘হামরা যার নুন খাই, তার গুণ গাই। শেখের বেটি ছাড়া কোনো কথাই নাই। হামরা নৌকায় ভোট দেমো।’
লালমনিরহাট-১ আসনের পাটগ্রাম উপজেলার জোংড়া ইউনিয়নের সঙ্গে একীভূত হয়েছে বিলুপ্ত ১১৯ নম্বর বাঁশকাটা (দয়ালটারী) ছিটমহল। বাঁশকাটা গ্রামের বাসিন্দা খোদেজা বেগম বলেন, ‘এতদিন তো হামরা আছনো (ছিলাম) ছিটের মাইনষে (মানুষ)। আগে ভোট দিবার পাই নাই। কিন্তু এবার হামরা বাংলাদেশি হিসাবে ভোট দেমো। হামরা খুব খুশি হইচি।’ কেমন প্রার্থীকে ভোট দেবেন জানতে চাইলে তাঁর সাফ জবাব, ‘অত কিছু বুঝি না। শুধু এইটুকু বুঝি বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর মেয়ে আমাদের জন্য অনেক কিছুই করেছেন। তাই আমাদের ভোটের সিদ্ধান্ত আমরা নিয়ে নিয়েছি।’
বাংলাদেশে ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে লালমনিরহাটে ছিল ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, নীলফামারীতে চারটি এবং কুড়িগ্রামে ছিল ১২টি। সবচেয়ে বেশি ছিটমহল ছিল উত্তরের জেলা লালমনিরহাটে। এখন সবই বিলুপ্ত এবং বাংলাদেশের অংশ। এর মধ্যে লালমনিরহাটের তিনটি সংসদীয় আসনের মধ্যে দুটি আসনের সীমানায় পড়েছে এসব বিলুপ্ত ছিটমহল। লালমনিরহাটের বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী আক্ষেপের সঙ্গে জানায়, দশকের পর দশক ধরে তারা বাংলাদেশে বিভিন্ন সংসদ নির্বাচন শুধু দেখেছে, কিন্তু বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে থেকেও ‘ভারতীয়’ বলে ভোট দিতে পারেনি। তবে এবার আর তারা চেয়ে চেয়ে দেখছে না। কেউ কেউ পছন্দের প্রার্থীর হয়ে প্রচার-প্রচারণাও চালাচ্ছে।
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় অবস্থিত বিলুপ্ত চার ছিটমহল ২৮ নম্বর বড়খানকি কান্দাপাড়া, ২৯ নম্বর বড়খানকি খারিজা গিদালদহ, ৩০ নম্বর বড়খানকি গিদালদহ, ৩১ নম্বর নগর জিগাবাড়ি গ্রাম। বিলুপ্ত ওই চার ছিটমহলের ১৬৮ দশমিক ৪৮ একর এলাকায় ১৫৭ পরিবারের বসবাস। সেখানের ছিটমহলগুলো ঘুরে দেখা গেছে, বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর মনে লেগেছে বাড়তি আনন্দের রোশনাই। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় অবস্থিত বিলুপ্ত ছিটমহল জিগাবাড়ি। ছিটমহল বিলুপ্তির পর ওই গ্রামটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নে। এই গ্রামের বাসিন্দা ৬০ বছর বয়সী খতেজা বেগম আনন্দের আভা ছড়িয়ে বলেন, ‘এইবার প্রথম এমপির ভোট দিমো বাহে। খুব খুশি লাগেছে।’ বয়স্ক ভাতা পান জানিয়ে খতেজা বেগম আরো বলেন, ‘হামরা ছিটমহলের মাইনষি আছিনো। এতদিন দ্যাশের সরকার গঠনোত ভোট দিবার হামার পারমিশন ছিল না। দুই মাস আগোত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বারের ভোট দিনো। সেই দিন ভোট দিবার পারি হামরা খুব আনন্দ পাইছি। এইবার সরকার গঠনোত ভোট দিমো, সেইটার জন্যে হামার খুব খুশি লাগেছে।’
প্রসঙ্গত, পঞ্চগড়-১ আসনে পঞ্চগড় সদর উপজেলার সাতটি বিলুপ্ত ছিটমহলের অবস্থান। পঞ্চগড়-২ আসনের বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলায় ২৯টি বিলুপ্ত ছিটমহলের অবস্থান।
পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত গাড়াতি ছিটমহলের সত্তরোর্ধ্ব বাসিন্দা ফয়জুল হক বলেন, ‘জীবনে খুব ইচ্ছে ছিল যেন বাংলাদেশি হিসেবে মরতে পারি। আমার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। বাংলাদেশের পরিচয় পেয়েছি। এবার জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারব। এ আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’
ছিটমহল আন্দোলনের নেতা মফিজার রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ যেমন স্বাধীন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তেমনি ছিটমহল স্বাধীন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার জাতীয় নির্বাচন আমাদের জন্য একটি ইতিহাস হয়ে থাকবে।’