Home জাতীয় আইসিইউ ও অক্সিজেনের জন্য হাহাকার, বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা

আইসিইউ ও অক্সিজেনের জন্য হাহাকার, বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা


বিশ্ববিদ্যায়ল পরিক্রমা : দেশে করোনার সংক্রমণ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আক্রান্তের পাশাপাশি বাড়ছে মুমূর্ষু রোগীর সংখ্যা। এদের চিকিৎসায় আইসিইউ বা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের শয্যার জন্য হাহাকার করছেন স্বজনরা। নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন আইসিইউতে রেখে রোগী চিকিৎসা দিতে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। রাজধানীর কোভিড নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর আইসিইউ শয্যার তুলনায় রোগীর চাপ অনেক বেশি। এছাড়া ঢাকার বাইরে সব জেলা হাসপাতালে নেই আইসিইউ শয্যা। আবার অনেক রোগীর অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। ফলে এই সময়ে আইসিইউ এবং অক্সিজেনের চরম ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রোগীর চাহিদার বিপরীতে আইসিইউ শয্যা ও অক্সিজেন সরবরাহ স্বাভাবিক রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সব জেলার হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। জেলা হাসপাতালগুলোয় ৫ শয্যার আইসিইউ স্থাপন করা হবে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় অতিরিক্ত দশ শয্যা করে আইসিআই স্থাপিত হবে। সব মিলিয়ে আরও ৩৭০টি আইসিইউ শয্য যোগ হতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে কাজও শুরু হয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে জানা গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১৩৭টি। এছাড়া ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলা হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৪৭টি, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলা হাসপাতালে ৩৪টি, ময়মনসিংহ বিভগের ৪টি জেলা হাসপাতালে ৭টি, বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলা হাসপাতলে ১৮টি, সিলেট বিভাগের ৪টি জেলা হাসপাতালে ১৬টি, রাজশাহী বিভাগের ৮টি জেলা হাসপাতলে ২৮টি, খুলনা বিভাগের ১০টি জেলা হাসপাতালে ১৮টি এবং রংপুর বিভাগের ৮টি জেলা হাসপাতালে আছে ১৩টি আইসিইউ শয্যা। সব মিলিয়ে সারা দেশে সরকারি পর্যায়ে আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ৩১৮টি। এছাড়া ঢাকায় বেসরকারি পর্যায়ে কোভিড নির্ধারিত হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ শয্যা আছে ৮১টি। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে সারা দেশে আইসিইউ শয্যা আছে ৩৯৯। অথচ সারা দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬৫ হাজার ৭৬৯ জন। এদের মধ্যে প্রায় আট হাজার রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাকিরা বাসায় চিকিৎসাধীন। মোট রোগীর ৫ শতাংশের বেশির আইসিইউ’র প্রয়োজন হয়। এতে প্রায় তিন হাজার রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট দরকার। অথচ সারা দেশে আছে মাত্র ৩৯৯টি। এর মধ্যে করোনার বাইরে অন্য রোগে আক্রান্তদেরও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র প্রয়োজন। সব মিলে এ ধরনের শয্যার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহও প্রকট আকার ধারণ করেছে।

এদিকে ঢাকার বাইরে দেশের মাত্র ৫টি হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া বাকি সব হাসপাতালে সিলেন্ডারের মাধ্যমে রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে হাসপাতালগুলো অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিলেও বর্তমানে সেই অবস্থা নেই বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। মানুষ অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনতে গিয়ে ফিরে আসছে। এ সুযোগে দুই-তিনগুণ বেশি দামে বিক্রি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মে মসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ঢাকার বাইরে অধিকাংশ হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলেও রোগীদের জন্য তা সরবরাহে পর্যাপ্ত সুবিধা নেই। ৯০ শতাংশ জেলা হাসপাতালে নেই এবিজি (আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস এনালাইজার) মেশিন। অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলেও ৮৯ শতাংশ হাসপাতালে নেই অক্সিজন কনসেনট্রেটর। ৯৫ ভাগ হাসপাতালে নেই বিপাপ ও সিপাপ (প্রেসার দিয়ে ফুসফুসে প্রয়োজনীয় অক্সিজন সরবরাহ করার যন্ত্র)। এমনকি অক্সিজেন মাস্কের ঘাটতি রয়েছে ৩০ শতাংশ হাসপাতালে। এসব সামগ্রী না থাকায় সিলিন্ডার তেমন কাজে আসছে না।

কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় আইসিইউ শয্যার সংকট দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সব জেলায় আইসিইউ স্থাপনের নির্দেশ দেন। মঙ্গলবার একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক জেলা সদর হাসপাতালে একটা করে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রত্যেক হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট, ভেন্টিলেটর স্থাপন এবং উচ্চমাত্রার পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা আরও বৃদ্ধির কথা বলেছেন। এজন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার নির্দেশও প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংক ও এডিবির অর্থায়নে ?দুটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্প দুটি সরকারপ্রধানের নির্দেশের আগেই অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। ওইদিন বৈঠকে ওই দুই প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর একটি হচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ‘কোভিড-১৯ রেসপন্স ইমার্জেন্সি অ্যাসিস্ট্যান্স (এডিবি-জিওবি)’ প্রকল্প। অন্যটি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’। প্রকল্প দুটির আওতায় কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত ও পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সক্ষমতা বাড়ানো হবে। জেলা হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট স্থাপনের মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সুযোগ বাড়ানো হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আমিনুল হাসান জানান, গত ফেব্রুয়ারি থেকেই জেলা হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ স্থাপন এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ শয্যা বাড়াতে কাজ শুরু হয়েছে। এই সংক্রান্ত কার্যক্রম অধিদফতরের পরিচালকের (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) দফতর থেকে পরিচালিত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে আইসিইউর অন্যতম অনুষঙ্গ ভেন্টিলেশন (মুমূর্ষু রোগীকে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দেয়া যন্ত্র) মেশিন সহজলভ্য নয়। কাজেই আইসিইউ স্থাপনের কাজ শেষ হতে সময় লাগবে। আগামী বছরের জুন-জুলাই পর্যন্ত লেগে যাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবির। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের জেলা হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ স্থাপনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আসছে অর্থবছরে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এতে জেলা হাসপাতালগুলোয় ৫টি করে আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হবে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় ১০টি করে অতিরিক্ত আইসিইউ শয্যা সংযুক্ত হবে। পাশাপাশি আইসিইউ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোকবল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৈরি সারা দেশের হাসপাতালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকা বিভাগের মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, নরসিংদী, রাজবাড়ী এবং ঢাকার জিনজিরা উপজেলায় নির্ধারিত কোভিড হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। চট্টগ্রাম বিভাগের খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, ফেনী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, বান্দরবান, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলায় কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুরে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। বরিশাল বিভাগের ভোলা, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুর জেলায় কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায় কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। রাজশাহী বিভাগে নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। খুলনা বিভাগের বাগেরহাট, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, যশোর, নড়াইল এবং মাগুরা জেলায় কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, গাইবান্ধা জেলায় কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনায় বলা আছে, হাসপাতালগুলোয় করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্রের ব্যবস্থা রাখতে হবে। আইসিইউ পরিচালনায় বা রোগীদের পরিচর্যায় নেই প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বা নার্স।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাসের মুমূর্ষু রোগীদের প্রধান জটিলতা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা। এ সমস্যার প্রাথমিক সমাধান হিসেবে রোগীকে চাহিদা অনুযায়ী অক্সিজন সরবরাহ করতে হবে। এতেই বেশির ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে উঠবেন। এক্ষেত্রে কারও কারও বেলায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউর প্রয়োজন পড়তে পারে। ফলে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় হাসপাতালগুলোয় অক্সিজেন সরবরাহ, এ সংক্রান্ত সরঞ্জাম ও এর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখার সংগৃহীত সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, দেশের ৫৭টি জেলা হাসপাতালে অক্সিজেন টিউব আছে। মাত্র ১০ শতাংশ হাসপাতালে আছে এবিজি (আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস এনালাইজার)। দুই-তৃতীয়াংশ হাসপাতালে পালস অক্সিমিটার রয়েছে। সব জেলা হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলে মাত্র ১০ শতাংশ হাসপাতালে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর আছে। দেশের ৫৩ শতাংশ হাসপাতালে নেজাল ক্যানোলা এবং দুই-তৃতীয়াংশ হাসপাতালে অক্সিজেন মাস্ক রয়েছে। মাত্র ৫ শতাংশ হাসপাতালে বিপিএপি এবং সিপিএপি আছে। মাত্র ১৪ শতাংশ হাসপাতালে মেকানিক্যাল (কারিগরি) ভেন্টিলেটর রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, আমার জানা মতে, রাজধানীসহ জেলা হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুদ রয়েছে। এছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই হাসপাতাগুলোয় অক্সিজেনের কোনো ঘটতি নেই। কিছু এক্সেসরিজের ঘাটতি থাকলে সেগুলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বর্তমানে উল্লেখযোগ্য কোনো সমস্যা নেই।