
ক্রস ফায়ারে নিহত শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান ও আলাউদ্দিন, রাকিবদের অন্যতম সহযোগীদের নিয়ে তেজগাঁও থানা যুবলীগের আহব্বায়ক আব্দুল কাদির ও যুগ্ম আহব্বায়ক সাইদুর রহমান বাবু, জসিম পাটোয়ারী ওরফে কানা জসিম, ওরফে এলাইচ নাঠা জসিম ও তাজুল ইসলাম সোহেল, ওরফে এলাইচ কিলার সোহেল ওরফে মাদক সম্রাজ্ঞী নাসিমার জামাই সোহেলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠেছে চাঁদাবাজদের স্বর্গরাজ্য।
রাজধানীর সবচেয়ে বৃহত্তম পাইকারি আড়ৎ তথা অর্থনীতির একাংশ হিসেবে খ্যাত কারওয়ান বাজার ছাড়া কোথাও নেই দিন-রাত চাঁদাবাজির দৃশ্য! সারা দেশে কম বেশি চাঁদাবাজি চোখে পড়ে। কোথাও দিনের বেলা, আর কোথাও রাতের বেলা। একেবারে দিন-রাত টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের উপর জুলুম করা চিত্র কিছুটা সিনেমা জগতে দেথা মেলে।কিন্তু বাস্তব চিত্র তারও উর্দ্ধে। নানা উপায়ে দিন-রাত চলে হরদম এ চাঁদাবাজি। আর এ চাঁদাবাজি অর্থ কোটি টাকার কাছাকাছি।সরেজমিন বেরিয়ে এসেছে চাঁদাবাজির একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
কারওয়ান বাজার ঘুরে ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন অন্তত ৫ হাজার পাইকারের আনাগোনা রয়েছে। পণ্য কেনা, পরিবহনে লোড করা, ভ্যান গাড়িতে পণ্য নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই গুনতে হয় নির্দিষ্ট পরিমাণের চাঁদা। শুধু তাই নয়, পণ্য কিনে ট্রাকে লোড করার জন্য একটি স্থানে সেগুলো রাখার জন্য চাঁদা দিতে হয়। চাঁদাবাজদের দাপটে ব্যবসায়ীরা অস্থির হলেও তাদের কাছে জিম্মি বলে নিরবে চাঁদা দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হলেও চাঁদাবাজরা তাদের রাজত্ব দিনদিন বড় করেই চলছে।
সাধারণত প্রতিদিন কারওয়ান বাজারে আসা ট্রাক প্রতি চাঁদা তোলা হয় ১শ থেকে ৩০০ টাকা করে। প্রতিরাতে কারওয়ান বাজারে অন্তত ৪শ ট্রাক পণ্য নিয়ে ঢোকে। গড়ে ২০০ টাকা করে চাঁদা ধরলে এক রাতে ট্রাক থেকেই চাঁদা ওঠে ৮০ হাজার টাকা। ট্রাক থেকে পণ্য নামিয়ে যেসব ভ্যানে তোলা হয় সেগুলোকে চাঁদা দিতে হয় ৫০ টাকা করে। কারওয়ান বাজারে বর্তমানে ৭শ ভ্যান গাড়ি রয়েছে। গড়ে প্রতিরাতে ৪শ ভ্যান গাড়ি চালু থাকলে এ খাত থেকে চাঁদা আসে ২০ হাজার টাকা।
বিভিন্ন আড়ৎ থেকে মালামাল কিনে সেগুলো আবার পিকআপে লোড করতে হলে পাইকারদের চাঁদা গুনতে হয়। ৫ হাজার পাইকার প্রতি রাতে ১০০ টাকা করে চাঁদা দিলে তার পরিমাণ রীতিমতো পাহাড় হয়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ টাকা।
সড়ক ও ফুটপাতে ভাসমান দোকানদার কাছ থেকেও আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের চাঁদা। সড়ক ও ফুটপাতে প্রতি রাতে এক হাজারের বেশি সবজির অস্থায়ী দোকান বসে। সকাল পর্যন্ত চালু থাকা এসব দোকানের জায়গাগুলোও চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে দোকান বসাতে হলেও তাদেরকে চাঁদা দিতে হয়। ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, তিন ফুট আয়তনের ভাসমান দোকানের জন্য ৪ হাজার ও ছয় ফুটের দোকানের জন্য মাসে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়।এছাড়া দোকানের জায়গা (ফুটপাত) বরাদ্দ পেতে অগ্রিম দিতে হয় অবস্থানভেদে ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। মাসিক ভাড়া ছাড়াও প্রতি রাতে বসার জন্য এসব অস্থায়ী দোকানদারদেরকে আরও ৫শ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়।
দিনের বেলা প্রধান চাঁদাবাজি হয় পার্কিংয়ের নামে। পার্কিংয়ের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ১০টি স্পট নির্ধারণ করে সেগুলো ইজারা দেয়। ইজারার নাম করে এসব স্পটে নির্ধারিত ৩০ টাকার পার্কিং ফি আদায়ের বদলে ইচ্ছেমতোন টাকা আদায় করা হচ্ছে। এছাড়াও জনতা টাওয়ার ও কিচেন মার্কেটের সামনে অবস্থান করা পিকআপ থেকে ১৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ অবৈধ। পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ভবন থেকে পার্কিংয়ের নামে চাঁদা আদায় করছে এ চক্র। কয়েকটি ভবনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হোটেল লা ভিঞ্চি প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা, ওয়ান ব্যাংক প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা করে পার্কিংয়ের জন্য দেয়। এসব টাকা সিটি করপোরেশনের বদলে সোজা চলে যায় ইজাদারের পকেটে।
আরো জানা যায়, কারওয়ান বাজারের প্রায় সব ব্যবসায়ীই গোপন চাঁদাবাজির শিকার। কোনও কোনও ব্যবসায়ী প্রাণের ভয়ে গোপনে চাঁদা দেন। কিন্তু প্রকাশ করেন না। নানাভাবে চাঁদাবাজির শিকার হওয়াদের মধ্যে অনেকে
চাঁদবাজরা বেশ কয়েকটি খাত বের করে সেগুলো থেকে নিয়ম করে চাঁদা আদায় করছে। চাঁদা আদায়ের সুবিধার্থে সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পদও বাগিয়ে নিয়েছে তারা। ফলে তাদের ওপর কথা বলার কেউ নেই কাওরান বাজারে। চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করতে যদিও কেউ আসে, তাহলে তাকে গুনতে হয় চরম মাশুল।
জানা গেছে, কাওরান বাজারে কাঁচা বাজার, কিচেন মার্কেট, মুরগি বাজারসহ পুরো পার্কিং স্পটগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন আব্দুল কাদির ও যুগ্ম আহব্বায়ক সাইদুর রহমান বাবু, জসিম পাটোয়ারী ওরফে কানা জসিম, ওরফে এলাইচ নাঠা জসিম ও তাজুল ইসলাম সোহেল ,ওরফে এলাইচ কিলার সোহেল ওরফে মাদক সম্রাজ্ঞী নাসিমার জামাই সোহেলসহ তাদের সহযোগীরা। সেই সঙ্গে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকটি অঙ্গ সংগঠন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ চক্রের একক নিয়ন্ত্রণেই কাওরান বাজারের ৮০ ভাগ অংশ। বাকি ২০ ভাগ রয়েছে অন্যান্যদের দখলে।
সিটি করপোরেশন থেকে পার্কিংয়ের ইজারা পান মতিন মৃধা। এ ইজারা পাওয়ার পেছনে বিপুল অর্থের লেনদেন হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ইজারা পাওয়ার পর থেকেই তিনি নির্ধারিত পার্কিং ফের কয়েকগুণ বেশি ফি আদায় করে যাচ্ছেন। বাধ্য হয়েই গাড়ির মালিককে সে টাকা গুনতে হচ্ছে। অপরদিকে বর্তমানে টেন্ডার জটিলতায় বর্তমানে পার্কিং স্পট সিটি করপোরেশনে সরাসরি তত্ত্ববধানে থাকলেও সেটা কেবল কাগজে কলমে রয়েছে বলেই জানা যায়। মূলত পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করছেন আব্দুল কাদির ও যুগ্ম আহব্বায়ক সাইদুর রহমান বাবু, জসিম পাটোয়ারী ওরফে কানা জসিম, ওরফে এলাইচ নাঠা জসিম ও তাজুল ইসলাম সোহেল ,ওরফে এলাইচ কিলার সোহেল ওরফে মাদক সম্রাজ্ঞী নাসিমার জামাই সোহেলসহ তাদের সহযোগীরা।
পুরো কাওরান বাজারে রয়েছে পাঁচটি জুয়ার আসর। এগুলোও নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের তত্বাবধানে। এসবের সঙ্গে পুলিশ ও সরকার দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের যোগ সাজশ আছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
অভিযোগ অনুযায়ী সন্ত্রাসী গ্রুপে রয়েছে বাচ্চু (৩৭), আউয়াল (৩৫), নাজির (২৮), শাকিল (২৫), মাল্টিপারপাস মামুন,(৪০) মুরগী বাবু (৪০), পিচ্চি পারভেজ (২৩) তানবির (২২), বাবা গনি (৩৮) ও লম্বা জাফর (৩৫)।
উল্লেখ্য সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজিদে বিরুদ্ধে একাধিক সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, খুন, অপহরণ, হত্যা ও ধর্ষণের মামলা রয়েছে। এর মধ্যে জসিম পাটোয়ারী ওরফে কানা জসিম ও তাজুল ইসলাম সোহেল ওরফে কিলার সোহেলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানার মামলার বিবরণ সংযুক্ত করা হলো।
এসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে একাধিক সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, খুন, অপহরণ ও হত্যা মামলা থাকার পরও তারা প্রশাসনের নিরবতায় আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এতে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। চাঁদা না দেয়ায় ইতিমধ্যে অনেকে উচ্ছেদের শিকার হয়ে অন্যত্রে চলে গেছে। শত শত ব্যবসায়ী আতঙ্কের পাশাপাশি ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
গত ৪ আগস্ট কারওয়ান বাজার-কেন্দ্রিক চাঁদাবাজদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, ‘চাঁদাবাজি-মস্তানি করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। আমরা এখানে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি, মস্তানি করতে দেব না।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই হুঁশিয়ারিতে কোনো কাজ হয়নি। তিনি আরো বলেন,কাওরান বাজারের চাঁদাবাজি ঠেকাতে স্থাপিত হচ্ছে পুলিশ ফাঁড়ি। খুব শিগগিরই এর কার্যক্রম শুরু হবে।
পুলিশের প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, কাওরান বাজার যেমন রাজধানীর অন্যতম কাঁচাবাজার, তেমনি এখানে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য সীমাহীন। আর কাওরান বাজারের চাঁদাবাজি নিয়ে গত তিন দশকে হানাহানির ঘটনাও কম হয়নি। গত তিন দশকে ট্রিপল মার্ডারসহ দেড় শতাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ট্রিপল খুনের ঘটনা ঘটেছিল ২০০৮ সালের শুরুর দিকে। তবে ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর কাওরান বাজারের দৃশ্যপট পালটে যায়। খুন মারামারির ঘটনা অনেকাংশে কমে যায়। তবে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি কমলেও অপ্রকাশ্যে চলছে চাঁদাবাজি।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. আনিসুর রহমান বলেন, কারওয়ানবাজারে বহুদিন ধরেই চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। কারওয়ান বাজারে দুইটি গ্রুপ চাঁদাবাজি করত। তার মধ্যে বড়টিই হলো পিচ্চি হান্নান গ্রুপ। এই গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছে আব্দুল কাদির ও যুগ্ম আহব্বায়ক সাইদুর রহমান বাবু, জসিম পাটোয়ারী ওরফে কানা জসিম, ওরফে এলাইচ নাঠা জসিম ও তাজুল ইসলাম সোহেল ,ওরফে এলাইচ কিলার সোহেল ওরফে মাদক সম্রাজ্ঞী নাসিমার জামাই সোহেলসহ তাদের সহযোগীরা। বর্তমানে পুলিশী তৎপরতার কারণে তাদের চাঁদাবাজি কিছুটা বন্ধ হয়ে গেছে। কারওয়ান বাজারকেন্দ্রিক চাঁদাবাজি পুরোপুরি বন্ধ করতে সেখানে শীঘ্রই একটি পুলিশ ফাঁড়ি বসানো হচ্ছে।