Home ব্যাংক-বীমা ব্যাঙ্কাসুরেন্স : প্রায়োগিক ভাবনা ২

ব্যাঙ্কাসুরেন্স : প্রায়োগিক ভাবনা ২

-মীর নাজিম উদ্দিন আহ্‌মেদ

মীর নাজিম উদ্দিন আহ্‌মেদ : এই বছরের মে মাসে ব্যাঙ্কাসুরেন্স : প্রায়োগিক ভাবনা নিয়ে একটি লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও অন-লাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছিল।

এই লেখায় ব্যাঙ্কাসুরেন্স চালু করলে কোন্‌ কোন্‌ বিষয়গুলো বিবেচনা করা দরকার, কি কি সমস্যা হতে পারে এবং বাস্তব অবস্থা বিবেচনা নিয়ে তা কিভাবে প্রয়োগের চিন্তা ভাবনা করলে সকল পক্ষের সন্তুষ্টির মাধ্যমে বীমা ব্যবসা বেগবান করা যায় সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছিল।

বীমা প্রতিদিনের চর্চা। বীমা ব্যবসা অগনিত উন্নয়ন কর্মকর্তা, এজেন্ট, এফ.এ. ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এদের বাদ দিয়ে তৃতীয় পক্ষীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার পূর্বে এদের ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিতে হবে যাতে এরা বেকার না হয়ে যায় এবং সরকারকে নির্বাচনকালীন সময়ে কোন বেকায়দায় পড়তে না হয়। কারণ ঘরে ঘরে কর্মসংস্থান সরকারের একটি অঙ্গীকার।

ব্যাঙ্কাসুরেন্স নীতিমালা ও কর্পোরেট এজেন্ট নির্দেশিকায় বীমা সেক্টরে যারা কর্মরত তাদের ব্যাপারে নির্দেশনা থাকা উচিত ছিল। বীমার কোন্‌ কোন্‌ ক্ষেত্র ব্যাঙ্কাসুরেন্স এর আওতাভুক্ত তা নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন ছিল। যখন নন-লাইফ বীমার শাখা ব্যবস্থাপকগণ পথে ঘাটে সোচ্চার তখন বলা হলো “এসএমই/রিটেইল ব্যাংকিং” আওতাভুক্ত প্রোডাক্ট ব্যাঙ্কাসুরেন্স-এ আওতাভুক্ত। কর্পোরেট মেরিন, অগ্নি, মেরিন হাল, ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি ব্যবসা ব্যাঙ্কাসুরেন্স আওতাভুক্ত নয়। কিন্তু ব্যাঙ্কাসুরেন্স নীতিমালা বা কর্পোরেট এজেন্ট নির্দেশিকায় এই ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই, থাকলে এই বিড়ম্বনার সৃষ্টি হতো না।

১৮ই জুলাই ২০২৩ ইং, অর্থ মন্ত্রনালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে “বাংলাদেশে তফসিলী বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাঙ্কাসুরেন্স প্রবর্তনের লক্ষ্যে গেজেট নোটিফিকেশন জারি করা হয়েছে।”

আবার ২০শে জুলাই ২০২৩ ইং, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন এর মাননীয় প্রেসিডেন্ট অর্থ মন্ত্রনালয় এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে “ব্যাঙ্কাসুরেন্স গাইডলাইন্স” কতিপয় সংশোধনের প্রয়োজনে সাময়িকভাবে স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়ে পত্র প্রেরণ করেছেন।

বিভিন্ন নন-লাইফ বীমা কোম্পানীর শাখা ব্যবস্থাপকদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ, অর্থ-মন্ত্রনালয়ে ব্যাঙ্কাসুরেন্স চালুর ফলে ব্যবসা সংগ্রহ ও তাদের চাকুরীর ক্ষেত্রে কি ধরনের সমস্যা হতে পারে তা তারা তুলে ধরেছেন। কর্তৃপক্ষ তা সদয় বিবেচনায় নিয়েছেন এটা একটা পজেটিভ দিক।

২০শে জুলাই ২০২৩ ইং, জনাব ফখরুল ইসলাম, ঢাকা কর্তৃক প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটা লেখা আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে “ব্যাঙ্কাসুরেন্স চালু করতে বীমা মালিকদেরই বাধা, নেপথ্যে কি?” আমি জানি না এই ভদ্র লোক বীমা শিল্পের সাথে সরাসরি জড়িত আছেন কিনা? যদি থাকতেন তবে লিখতেন ব্যাঙ্কাসুরেন্স গাইডলাইন, ব্যাঙ্কাসুরেন্স নীতিমালা প্রনয়নের সময় বীমার ক্ষেত্র, বীমা কর্মীদের চাকুরীর নিরাপত্তা, বীমা সেক্টর কেন ব্যাংক এর উপর নির্ভরশীল হবে? সদাশয় সরকার কেন ব্যাংক ও বীমা দুটি সেক্টরই আলাদা আলাদা আইন প্রনয়নের মাধ্যমে অনুমোদন দিয়েছেন ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করতেন। তা না করে বীমা সেক্টরের জন্য নেগেটিভ রিপোর্ট করলেন। এমনিতেই বীমা সেক্টর বিভিন্ন বিষয়ে নাজুক অবস্থানে রয়েছে।

লেখক তার লেখায় ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে জীবন বীমা ব্যবস্থা চালু আছে বলেছেন সাধারন বীমা নয়, এই বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। ব্যাঙ্কাসুরেন্স নিয়ে ফাউন্ডেশন ফর দ্যা এডভান্সমেন্ট অব লাইফ এন্ড ইন্স্যুরেন্স এরাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড (এফএএলআইএ) পরিচালিত এক জরিপে বলা হয় ব্যাংকের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি, লাইফ পলিসি বিক্রী হয় তুরস্কে ৭৯%। এটা আমলে আনতে হবে।

ব্যাঙ্কাসুরেন্স নিয়ে আমাদের দেশে তেমন কোন গবেষণা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনষ্টিটিউটের (আইবিএ) শিক্ষক মোহাম্মদ জেড মামুন কয়েক বছর আগে এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন যে, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানী, স্পেন, নেদারল্যান্ড এই সব দেশে জীবন বীমা পণ্য বিক্রী করা হয়। সেদিক বিবেচনা করে ব্যাংকের মাধ্যমে জীবন বীমা পণ্য বিক্রী করা সম্ভব (জনাব মামুন সাহেব সম্ভবতঃ আইডিআরএ-এ মেম্বার হিসেবে কিছু সময় কাজ করেছিলেন)। কোন জীবন বীমা পন্যই আমাদের দেশে ব্যাংকের মাধ্যমে বিক্রী হয় না। অন্য দিকে নন-লাইফ বীমা ব্যাংক-কে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে তাদের উন্নয়ন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বিক্রী করে থাকে। এই উন্নয়ন কর্মকর্তাদের নিজস্ব পদ-পদবী রয়েছে। তাছাড়া তাঁরা পার্মানেন্ট এমপ্লয়ি হিসাবে গাড়ীসহ প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুয়েটিসহ সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকেন। ব্যাঙ্কাসুরেন্স চালু হলে তাঁরা এই সব থেকে বঞ্চিত হবেন। বীমা বেসরকারীকরণের ৩৮ বছর পর চলমান পদ্ধতিকে আধুনিকায়নে যুক্তি সংগত ও বাস্তব ভিত্তিক অবকাঠামো তৈরী করেই সংস্কার করতে হবে। তাহলেই সংস্কার বা আধুনিকরন ফলপ্রসূ হবে।

ব্যাংক ও বীমা পৃথক সত্তা। এই দুটিকে এক করার কোন মানে নেই। যেমন দুর্বল ও দুর্বিত্তায়িত বীমা কোম্পানি রয়েছে তেমনি ব্যাংক এই ব্যাপারে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। এমনি অবস্থায় ব্যঙ্কাসুরেন্স ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাপক দুর্বিত্তায়নের সংস্পর্শে এসে আর্থিকখাত দুমড়ে মুচড়ে মুখ থুবড়ে পরবে।

তাই ব্যাঙ্কাসুরেন্স চালুর পূর্বে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে সঠিক অবকাঠামো তৈরী করতে হবে। বীমা ব্যবসায় কোন্‌ কোন্‌ শ্রেনীর ব্যবসা ব্যাঙ্কাসুরেন্স কভার করবে ও বীমাযোগ্য মূল্যের পরিধি কি হবে বা কোন্‌ কোন্‌ শ্রেনীর ব্যবসা ব্যাঙ্কাসুরেন্স এর আওতায় আসবে তা পূর্বেই নির্ধারিত হতে হবে; ব্যাংক এই খাতে সর্বোচ্চ কত পার্সেন্ট কমিশন পাবে তাও নির্ধারিত হতে হবে, ব্যাংক কর্মকর্তারা যদি কমিশনের অতিরিক্ত কিছু দাবী করেন সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে কিভাবে অবহিত করতে হবে বা অবহিত হওয়ার পর কর্তৃপক্ষের করণীয় কি হবে (বর্তমানে ব্যাংক কর্মকর্তাদের দ্বৈরাত্বের কারণেই মার্কেটে অনৈতিক কমিশন চর্চা) এছাড়াও আরো অনেক বিষয় চিন্তা ভাবনায় আনতে হবে।

বীমা শিল্পের মালিকদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন। এই এসোসিয়েশনে যারা কর্তা ব্যক্তি তাদের নিজস্ব বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের যদি স্বদিচ্ছা থাকে বীমা খাত সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় বেড়ে উঠুক তবে তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানকেই আগে নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোতে আনতে হবে তাহলে বীমা খাতের সংস্কার বা যে কোন পদ্ধতি বাস্তবায়ন ওয়ান টু-র ব্যাপার মাত্র।
পরিশেষে দক্ষ জনবল তৈরী করার উদ্যোগের মাধ্যমে ডাইভারসিফাই প্রোডাক্ট নিয়ে যাতে সকলেই এগিয়ে আসে সে ব্যাপারে সকলকে উজ্জীবিত করতে হবে। দুর্বল বীমা কোম্পানীগুলোকে সার্বিক সহযোগীতার মাধ্যমে মান উন্নয়নে সহায়তা করতে হবে। সম্মিলিতভাবে সকলের সায় ও অংশগ্রহনের মাধ্যমেই বীমা শিল্পকে এগিয়ে নিতে হবে।

ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও
ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড