Home ব্যাংক-বীমা বীমা শিল্প থেকে কমিশন প্রত্যাহার এবং মোটর বীমা বাধ্যতামূলক করা হউক

বীমা শিল্প থেকে কমিশন প্রত্যাহার এবং মোটর বীমা বাধ্যতামূলক করা হউক

- মোঃ রফিকুল ইসলাম

মোঃ রফিকুল ইসলাম : বীমা ব্যবসা একটি রাজকীয় ব্যবসা। আমরা যারা বীমা কোম্পানীতে কাজ করি আমাদের কোন নগদ অর্থের প্রয়োজন হয় না। যেমনটা বলেছিলেন, আমার শ্রদ্ধাবাজন স্যার। তিনি বলেছিলেন সি.এ. (চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস) পড়তে টাকার দরকার হয় না, শুধুমাত্র একটি ক্যালকুলেটর, একটি রাবার (ইরেজার) এবং একটি কাঠ পেন্সিলই যথেষ্ট। তেমনিভাবে বীমাকারী প্রতিষ্ঠানের নগদ অর্থের প্রয়োজন হয় না। তাদের বীমা পলিসি প্রদানের জন্য শুধুমাত্র বিশ্বস্ততা, ভালোবাসা এবং সেবা প্রদান করাই বীমাকর্মীদের মুল লক্ষ্য উদ্দেশ্য। বীমাকর্মীগণ সেই লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়েই বীমা শিল্পে কাজ করে থাকেন।

রাস্তায় একজন ট্রাফিক যেমন ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন তেমনিভাবে একজন বীমা কর্মী পার্টির সম্পদের নিরাপত্তায় বীমা কভারনোট ও বীমা পলিসি নিয়ে ঝড়-বৃষ্টি, রোদ উপেক্ষা করে ব্যাংক ও পার্টির অফিসে হাজির।

আমাদেরকে বীমা ব্যবসা আহরণে সার্বক্ষণিক সচেষ্ট থাকতে হয়, কিভাবে ব্যাংকার এবং বীমা গ্রহীতাকে সন্তষ্ট রাখা যায়। কারণ প্রতিযোগীতামূলক মার্কেটে যে যত ভাল সেবা দিতে পারবেন সে তত ব্যবসা আহরণ করতে পারবেন।

মার্কেটিং মানেই প্রতিযোগীতা। পার্টির সাথে ভালো ব্যবহার, সঠিক সময় পণ্য পৌঁছে দেয়া। যে যত বেশী ভালো সার্ভিস দিবেন সে তত বেশী পণ্য সেল দিতে পারবেন। পার্টিকে আকৃষ্ট করতে মাঝে মাঝে কিছু বিশেষ অফার ঘোষণা করা হয়। যেমন ভালো ব্রান্ডের কলম ও ভালো ব্রান্ডের চামড়ার মানিব্যাগে কোম্পানীর নিজস্ব লোগো প্রিন্ট করে উপহার দেয়া হয়।

এমনও দেখা যায় প্রচার প্রশারের জন্য বড় বড় পার্টি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকারকে শহরের নামিদামি হোটেল রেস্তোরায় ডিনারে নিমন্ত্রণ করা হয় আবার কেউ কেউ মেজবান করে ব্যাংকার, বীমা গ্রহীতাকে আপ্যায়ন করে থাকেন। এক কথায় যে দেবতায় যে ভোগ চায়। বীমা কর্মীরা তাদেরকে সন্তষ্ট রাখতে তা-ই করে থাকেন।

আমাদের ছোট একটা দেশে নন-লাইফ বীমা কোম্পানীর সংখ্যা ৪৭টি। বীমা কোম্পানী অনুযায়ী শিল্প ও কলকারখানা সেইভাবে গড়ে উঠে নাই। তারমধ্যে বীমা কোম্পানীসমূহের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ‘আইডিআর’ ক্ষেত্র বিশেষ ‘ট্যারিফ রেট’ কমিয়ে দিয়েছেন। এতে পার্টিরা আইডিআরএ’র এই মহতী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেও বীমা কোম্পানীসমূহ মনোক্ষুন্য। অর্থাৎ মরার উপর খাড়ার ঘা’র সামিল নয় কি? এমনও অনেক কোম্পানী আছে বীমা না করে নিজেদের উদ্যোগেই মালামাল আমদানি রপ্তানি করে থাকেন।

সরকার মোটর গাড়ীর ইন্স্যুরেন্স বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়েছেন। যার অর্থ মোটর গাড়ীর ইন্স্যুরেন্স করলেও করতে পারেন না করলেও কোন সমস্যা নেই। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই মোটর গাড়ীর ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলক। সেখানে কেন বা কাদের স্বার্থে সরকার এরুপ আদেশ দিয়েছেন তা আমাদের বোধগম্য নহে। সরকারের এই আদেশ বীমা কোম্পানীগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এই আদেশের কারণে ইন্স্যুরেন্স কমে গিয়েছে। বীমা কর্মীরা ঠিকমত বেতন পাচ্ছেন না। তাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। পাশাপশি সরকার লক্ষ লক্ষ টাকার রাজস্ব হারিয়েছে।

রাস্তায় যানবাহন চলাচলে ট্রাফিক থাকেন, ট্রাফিক সার্জেন থাকেন। যানবাহনের নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক গাড়ী চেক করতেই গাড়ীর ইন্স্যুরেন্স সার্টিফিকেট, গাড়ী ব্লুবুক, চালকের লাইসেন্স দেখে থাকেন। সেক্ষেত্রে মোটর গাড়ীর ইন্স্যুরেন্স করা আবশ্যক। কোনভাবেই মোটর ইন্স্যুরেন্স তুলে দেয়া ঠিক হয়নি। অবশ্যেই আমাদের দেশে মোটর গাড়ীর ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামুলক থাকা উচিৎ এবং সময়ের দাবী। অন্যথায় বীমা কোম্পানীগুলো অচিরেই রুগ্ন হয়ে পড়বে।

আমাদের বীমা ব্যবসায় দিন দিন যেভাবে প্রতিযোগীতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে অনৈতিক কমিশন লেনদেন হচ্ছে। বীমা ব্যবসায় কে কত কমিশন দিতে পারবে তার উপর নির্ভর করছে বীমা ব্যবসা। ফলে বীমা দাবী পরিশোধের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে।

বীমা কোম্পানী এবং বীমা গ্রহীতার উভয়ের একটা বিষয়ে মনে রাখা উচিৎ। বীমা গ্রহীতার কোটি কোটি টাকার সম্পদের নিরাপত্তার বীমা ঝুঁকি গ্রহণ করেছেন। বীমা কোম্পানী বীমা গ্রহীতার সুখ দুঃখের সময় পাশে থাকবে। সময় মতো ক্ষতিগ্রস্থ সম্পদের ক্ষতিপুরণ দিবে। সেখানে অবৈধ অনৈতিক কমিশন বাণিজ্য যাহা গরু-ছাগলের দালালদের মতো কমিশনের দরকষাকষি জাতির জন্য এটা খুবই দুঃখজনক। গার্মেন্ট ইন্ডাষ্ট্রিজের পড়েই বীমা শিল্পে শিক্ষিত লোক চাকুরী করেন। তাদের মাধ্যমে যদি এই অনৈতিক কমিশন লেন-দেন হয়, তাহলে জাতি কোথায় দাঁড়াবে?

সরকারী কাজে ফাইল স্বাক্ষরের আগেই যেমন -% ঘুষ আদান প্রদান করা হয়, ঘুষ না দিলে বড় সাহেব স্বাক্ষর করবেন না, পিয়ন চাপরাষীকে টিপস না দিলে ফাইল মুভ করবে না, গেইটের দারোয়ানকে বকসিস না দিলে গেইটে আটকাবে। তদ্রুপ বীমা গ্রহীতা ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকার অনৈতিক কমিশন না পেলে কাজ দিবে না। তাই বীমা কর্মীরা উপায়ন্তর না পেয়ে বুঝে শুনেই অন্দকারে সাপের গর্তে পা রাখতে বাধ্য।

বীমা কোম্পানী সময় মতো বীমা দাবী পরিশোধে গড়িমসি করে। বিষয়টি স্পষ্ট কারণ আপনি ফলের আশায় গাছ রোপন করেছেন। গাছ বড় না হতেই যদি পাতা খেয়ে ফেলেন তাহলে গাছ কি বড় হবে, আপনাকে ফল দিবে? না, আপনার কোটি কোটি টাকার নিরাপত্তার জন্য বীমা ঝুঁকি নিয়েছেন অথচ আগেই অনৈতিক কমিশন নিয়েছেন। সেক্ষেত্রে কি আপনার ক্ষতিগ্রস্থ সম্পদের বীমা দাবী পেতে পারেন। আপনার বিবেক আপনার মন কি বলে? নিজেকে জিজ্ঞেস করুন। এরপরও আইডিআরএ মধস্থতায় বীমা দাবী পরিশোধ করা হয়।

বীমা অধিদপ্তর বিলুপ্ত করে আইডিআরএ’র জন্ম। পুরাতন আইন বাতিল করে সময়োপযোগী আইন করা হয়েছে, আবার সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়। প্রশ্ন কার স্বার্থে নিশ্চয়ই জনস্বার্থে। আইডিআরএ একবার কমিশন বাতিল আবার এজেন্সি কমিশন চালু। এটা কেমন ব্যাপার। এটাতো আপনার ব্যক্তিগত মেটার নয় যে, আজকে ইলিশ মাছ খাবো, কালকে রুইমাছ খাবো। এটা বৃহত্তর মেটার এবং এটার সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়িত। আপনি যখন যা ইচ্ছা তা করতে পারেন কি? তদন্ত করে দেখুন যখন কোন কমিশন ছিল না তখন কোম্পানীগুলো কেমন ছিল এবং কমিশন চালুর থেকে কোম্পানীগুলো কেমন চলছে।

বীমা কর্মীরা অসহায়, বীমা ব্যবসা না করতে পারলে বেতন ভাতা হয় না। বেতন ভাতা না পেলে কিভাবে সংসার চলবে, কিভাবে বাড়ী ভাড়া দিবেন, কিভাবে বাচ্চাদের স্কুলে কলেজে পড়াবেন। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে বীমা গ্রহীতা ও ব্যাংকারের অবৈধ্য কমিশনের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান।

বীমা ব্যবসা আহরণে বীমা কর্মী এবং পার্টি তারাহুরা করেন। এমনও দেখা যায় পার্টির মালামাল রক্ষিত গোডাউনের ঠিকানা, শ্রেনী ভুল করেন। ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হলে ঠিকানা বা শ্রেনীর জন্য দাবী পরিশোধে বীমা কোম্পানীরা অনিহাবোধ করেন।

কবির ভাষায় “ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল” অর্থাৎ ছোট থেকেইু বৃহত্তের সৃষ্টি। যদি আইডিআরএ পুনরায় ১৫% এজেন্সি কমিশন অনুমোদন না দিতেন তাহলে মার্কেটে আজ ৫০%-৬০% কমিশন বাণিজ্য হতো না। এটা বন্দ না হলে ভবিষ্যতে এবং ভয়ংকর সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। তাই বীমা শিল্পকে শৃংখলায় ফিরিয়ে আনয়নে ০% (জিরো) কমিশন করা হউক।

এভাবে চলতে থাকলে বীমা গ্রহীতা ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকারদের দরকষাকষিতে আগামীদিনে ৮০% কমিশন দাঁড়াবে। এমনও হতে পারে যেহেতু চাইলেই পেয়ে যায় সেহেতু কোন দিন যেন বীমা গ্রহীতা ও ব্যাংকার ১০০% কমিশনের প্রস্তব দিয়ে বসেন। আমরাও সেই অপেক্ষায় রইলাম।

বীমা কোম্পানীর অভিভাবক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আইডিআরএ’র প্রতি আবেদন বীমা শিল্পকে বাঁচতে দিন, এখানে লক্ষ লক্ষ লোক কাজ করে জীবন জীবিকা অর্জন করছেন। এই শিল্প নষ্ট হলে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। তাই বৃহত্তর স্বার্থে এজেন্সি কমিশন ১৫% বাতিল করে ০%(জিরো) কমিশন করা হউক। তবেই এই শিল্প বাঁচবে, সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পাবে, লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্ম সংস্থান হবে, বেকারত্ব দূর হবে।

লেখক : মোঃ রফিকুল ইসলাম। একান্ত সচিব, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোঃ লিঃ, ঢাকা, বাংলাদেশ।