Home ক্যাম্পাস খবর রিসার্চ সোসাইটিঃ এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের শুভ সূচনা

রিসার্চ সোসাইটিঃ এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের শুভ সূচনা


এস.এম. শাহরিয়ার আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিঃ

চীনের নানজিং ইউনিভার্সিটি অফ ইনফরমেশন সাইন্স এন্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটিতে অ্যাটমোস্ফেরিক ফিজিক্স এন্ড এটমোস্ফেরিক এনভায়রনমেন্ট এর উপর পিএইচডি করছেন পঞ্চগড়ের ছেলে মোঃ জালাল উদ্দীন। অনার্স করেছেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এর উপরে। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য ২০১৭ সালে স্কলারশীপ নিয়ে দেশ ছাড়েন। চীনের অ্যাপ্লাইড মেটেরিওলোজির ল্যাবে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারেন অ্যানালাইটিক্যাল কাজে তার কতটা গ্যাপ থেকে গিয়েছে। দেশে থাকতে জনে জনে ধর্ণা দিয়েও কারো কাছ থেকে কাজ শিখতে পারেন নি, যতটুকুই বা কিছুটা সুযোগ ছিলো সেটাও অল্প সংখ্যক পেইড কোর্স, আর ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ করে ট্রেনিং নেওয়াটা, টিউশনি করিয়ে নিজের খরচ চালানো জালাল উদ্দিনের জন্য ছিল অসম্ভব। সেকারনে, চীনে যাওয়ার পর থেকে তিনি ল্যাবেই পড়ে থাকতেন, চীনের বৈরী আবহাওয়ায় মাইনাস তাপমাত্রা, বাইরে ৭-৮ ইঞ্চি বরফ পড়তো, তার ভেতরেও ল্যাবে গিয়ে পড়ে থেকেছেন। চীনের নিয়ম অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থী বছরে চারমাস ছুটি কাটাতে পারে, সেই ছুটি গুলোকেও বিসর্জন দিয়েছেন নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য। একে একে শিখেছেন GrADS, Fortarn, NCL, Matlab, C, SPSS এবং Python এর মত কঠিন সফটওয়্যার এবং প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ গুলো। সেই সাথে মনে মনে এক দৃঢ় সংকল্প নিয়েছিলেন, নিজে যেটা কোথাও পাননি সেইটাই অন্যদেরকে দিবেন। এরপর চীনে ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদেরকে বিনামূল্যে ম্যাটল্যাব ট্রেনিং দিয়েছেন, তার কাছ থেকে ম্যাটল্যাবের ট্রেনিং নিয়েছেন এশিয়া এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশের শিক্ষার্থীরা। ইচ্ছা ছিলো মাস্টার্স ডিগ্রী নেওয়া শেষ হলে, পিএইচডি করার জন্য অস্ট্রেলিয়া,  আমেরিকা কিংবা কানাডায় পাড়ি জমাবেন। তার গবেষণা কাজে মুগ্ধ হয়ে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রা তাকে পিএইচডি স্টুডেন্ট হিসেবে আমন্ত্রন ও জানান। কিন্তু এর মাঝেই কাল হয়ে দাঁড়ায় বৈশ্বিক মহামারী করোনা। থমকে যায় তার উচ্চতর গবেষণার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমানোর পথও। এরপর অ্যাপ্লাই করেন চাইনিজ গভর্নমেন্ট স্কলারশীপের জন্য, এবং সেখানেও সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হন।

 

এরপর মোঃ জালাল উদ্দীন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছা থেকে, দীর্ঘদিনের সঞ্চয় করা অভিজ্ঞতা নিয়ে PSTU Career Club এর সহায়তায়, ২০২০ সালের ১৭ ই এপ্রিল “ডাটা সায়েন্স এন্ড বেসিক স্টাটিস্টিক্স” নামে একটা বিনামূল্যে ট্রেনিং এর আয়োজন করেন বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য। গবেষণা কাজে বহুল ব্যবহৃত টুলস SPSS এর কাজ শেখানো হয় এই ট্রেনিং এ। মাত্র ৮ টি সেশনে সমাপ্ত হওয়া ট্রেনিং সেশন টিতে অংশগ্রহণকারিদের উচ্ছাস ছিল অন্য রকম। শুরুতে বাংলাদেশের ৮ টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এই ট্রেনিং এ অংশ নেন, এবং সফল ভাবে ট্রেনিং টি শেষ করেন। এরপর প্রথম দিককার অংশগ্রহনকারীদের নিয়েই বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করা এবং বিনামূল্যেই প্রয়োজনীয় রিসোর্স এবং ট্রেনিং সেবা দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা শুরু করে Research Sosciety. এটি একটি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক সংগঠন, যেটি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, গবেষণা সেক্টরে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক মেধাবী এবং উদ্যমী শিক্ষার্থী থাকার পরও যথাযথ দিকনির্দেশনার অভাবে তারা গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তাটা খুঁজে পায়না ফলশ্রুতিতে দেশের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়কে ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিং এর অনেক নিচের থেকে খুঁজে আনতে হয়।

 

২০২০ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে যাত্রা শুরুর পর থেকেই রিসার্চ সোসাইটি নিয়মিত সম্পূর্ন বিনামূল্যে রিসার্চের জন্য প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা এবং প্রশিক্ষণের আয়োজন করে আসছে। শুরুতে রিসার্চ সোসাইটির মাধ্যমে Data science and statistics based on SPSS ট্রেইনিং দেওয়া হয়। এর পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ও তাসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, চায়নার NUIST সহ বিভিন্ন দেশের অধ্যাপক এবং গবেষকদের নিয়ে দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে বিভিন্ন একাডেমিক, ও মোটিভেশনাল টক এর আয়োজন করা হয়। তার মধ্যে,

” Think about science a pathway to research career “,

” How to manage scholarship and build a career in the research sector “,

” How to write a thesis paper and research proposal “,

” How to manage professor in USA, Australia, and Canada “,

” How to manage professor and scholarship a pathway to manage academic documents “. ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

দেশ ও বিদেশের শিক্ষার্থীদের পাদচারণায় রিসার্চ সোসাইটি এখন মুখরিত। Chittagong University Scientific Society (CUSS) এবং Research Society (RS) এর যৌথ উদ্যোগে দুই শতাধিক অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে আয়োজিত হয় “Basic guidelines to publish a scientific research paper” নামক সেমিনার। এছাড়াও নতুনদের গবেষণায় অনুপ্রাণিত করতে প্রতি সাপ্তাহে গবেষণা বিষয়ক প্রশ্নোউত্তর নিয়ে “Inside story from my heart: A journey to research society” নামক লাইভ সেশন আয়োজিত হয়।

 

রিসার্চ সোসাইটি, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গবেষনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য নিয়মিত স্কলারদের নিয়ে একাডেমিক টকের আয়োজন করে থাকে। এছাড়া রিসার্চ সোসাইটির অধীনে বর্তমানে “মেশিন লার্নিং” নামক একটি কোর্স চলছে। ইতিমধ্যেই “জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমস” GIS নামে অন্য আরেকটি কোর্স শুরু হয়েছে, যাতে অংশ নিচ্ছে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষানবিশ।

 

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞাসা করলে Research Society এর ফাউন্ডার মোঃ জালাল উদ্দীন বলেন, বর্তমানে চলমান কোর্স গুলো শেষ হলে তিনি বিনামূল্যে IELTS এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এরও ট্রেনিং দিতে চান। রিসার্চ সোসাইটি এর পরবর্তী কার্যক্রম হিসেবে থাকবে, “Computer programming and data analysis with Python”, “Machine Learning with Python, Scientific data analysis with Matlab and NCL”, “IELTS couching”, ইত্যাদি।

 

 

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সকল শিক্ষার্থীরাই যেন এখান থেকে উপকৃত হতে পারেন এবং আর্থিক অপারগতা যেন কারও রিসার্চ এবং এ সম্পর্কিত স্কীল গুলো ডেভলপমেন্টের পথে অন্তরায় হতে না পারে সেইলক্ষ্যে অনলাইন এডুকেশন প্লাটফর্ম গুগল ক্লাসরুমের মাধ্যমে ট্রেনিং কার্যক্রম শুরু করে Research Society। রিসার্চ সোসাইটির Google Classroom Code: 3r7qgrs ব্যবহার করে সহজেই যে কেউ যেন এখানে থাকা রিসোর্স গুলো একসেস করতে পারেন, সেজন্য গুগল ক্লাসরুম একসেস সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ফেইসবুক এবং ইউটিউবের মাধ্যমেও রিসার্চ সোসাইটির কনটেন্ট গুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে যাতে করে সহজেই রিসার্চ সোসাইটি সবার কাছে পৌছাতে পারে। এই প্লাটফর্মটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে রিসার্চ সোসাইটির ফাউন্ডার মোঃ জালাল উদ্দীন বলেন, বাংলাদেশে রিসার্চ সেক্টরে বড় একটা শুন্যতা থেকে গিয়েছে যার কারন হচ্ছে, এদেশে কেউ নিজে কিছু জানলেও সহজে অন্যদের শেখাতে চান না, তিনি বলেন বাংলাদেশে এই অশুভ সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই একটা সামাজিক আন্দোলন হিসেবেই রিসার্চ সোসাইটি কাজ করতে চায়। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ১৬ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখানে কাজ করছেন, নিজেরা শিখছেন এবং অন্যদের শেখাচ্ছেন। তিনি আশা করেন এই প্লাটফর্মটির মাধ্যমেই একদিন দেশের গবেষণা খাত সহ অন্যান্য খাতে সার্বিক উন্নয়নের একটা নব জাগরণ দেখতে পাওয়া যাবে। এছাড়াও রিসার্চ সোসাইটি স্নাতক ও স্নাতক-উত্তর পর্যায়ে SCI ও SCIE জার্নালে পেপার পাবলিশকারীদের এক কালীন বৃত্তির ঘোষণা দিয়েছে যা অচিরেই বাস্তবায়িত হবে।

Research Society এর ভবিষ্যত পরিকল্পনার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে মোঃ জালাল উদ্দীন বলেন, বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণায় গণিতের বিকল্প নেই। আমি এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে গবেষণা সেক্টরের উত্তরোত্তর উন্নতির মাধ্যমে আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সকলের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।

রিসার্চ সোসাইটির ইউটিউব চ্যানেলঃ http://www.youtube.com/c/MdJalalUddindmjalal90

রিসার্চ সোসাইটির ফেইসবুক পেজঃ https://www.facebook.com/researchsociety20/