Home ঢাকা ক্যাম্পাস গবির শিক্ষকদের গবেষণায় তৃতীয় লিঙ্গের বাস্তবতা

গবির শিক্ষকদের গবেষণায় তৃতীয় লিঙ্গের বাস্তবতা


বিশ্ববিদ্যায়ল পরিক্রমা প্রতিবেদক : স্বাভাবিক জীবন থেকে ছিটকে পড়া জনগোষ্ঠীর অন্যতম হলো সমাজের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। দেখতে দশ জন সাধারণ মানুষের মত হলেও শারিরীক ও আচরণগত দিক থেকে তারা কিছুটা আলাদা। তাদের অঙ্গভঙ্গি, কথাবার্তা অন্য সাধারণ মানুষের মত না হওয়ায় অনেক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা। এমন কি পায় না মৌলিক অধিকার গুলোও!

এখানেই শেষ নয়, বরং সমাজ তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার বদলে ঠেলে দেয় অন্ধকার আর অনিশ্চিত জীবনের দিকে, যেখানে যৌন হয়রানি সহ অন্যের তিরস্কার হয় তাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। এভাবেই সমাজের কড়া ঘাতে পিস্ট হয়ে একদিন পাওয়া না পাওয়ার হিসাব না মিটিয়েই চলে যায় তারা না ফেরার দেশে।

তবে আশ্চর্য্য জনক হলেও সত্য যে সমাজ তাদের দায়ভার নিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ, যে সমাজ তাদের যেতে বাধ্য করে অনিশ্চিত অন্ধকার জগতের দিকে, সেই সমাজ ব্যবস্থাই আবার তাকে দোষী সাবস্ত প্রতি ধাপে, এমন কি মৃত্যুর পরে করেনা লাশের জানাজার ব্যবস্থা , হয় না তাদের কবর , লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় পানিতে।

এমন অনেক অদ্ভূত পীড়াদায়ক সত্য ঘটনা উঠে এসেছে “Meeting Sustainable Development Goals ( SDG ) : Food and Livelihood perspective at Transgender Community in Bangladesh” গবেষণা পত্রে।

সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে দীর্ঘ এক বছর যাবৎ তৃতীয় লিঙ্গের উপর গবেষণার পর এমন অনেক তথ্য তুলে আনেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষক, সাকিনা আক্তার (ইংরেজি বিভাগ) পরিচালক রিসার্সটিম, নাজনীন পারভীন মিতু (পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ) সহ-পরিচালক, তাহমিনা সুলতানা (সমাজ বিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগ) সহ-পরিচালক মো: তৌহিদুল ইসলাম (ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ) সহ-পরিচালক রিসার্সটিম।

গবেষনার জন্য এই চার সদস্যের টিম ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের রাজশাহী, নাটোর, মানিকগঞ্জ এবং সাভার অঞ্চলের বহু এলাকায়। তাদের গবেষণা ছিল এই অঞ্চলগুলোর প্রায় ২০০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের উপর।

গবেষণায় যে বিষয়টি চরম ভাবে ফুটে উঠেছে তা হলো তৃতীয় লিঙ্গের উপর ধাপে ধাপে যৌন নিপীড়ন, সামাজিক ভাবে তাদের চরম রকমের হীন করে দেখা, তাদের প্রতি ঘৃণা, ধর্মীয় ও সামাজিক ভাবে তাদের একঘোরে করে রাখা, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত না করা, তাদের জন্য কর্ম সংস্থানের সুযোগ না, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার উৎসাহ দেওয়ার বদলে সমাজ থেকে বিতাড়িত করা সহ অনেক বিষয়।

তবে সব অঞ্চলে সব সমস্যাগুলো এক সাথে না থাকলেও বেশির ভাগ সমস্যার মুখোমুখী হতে হচ্ছে তাদের। আবার শহর ও গ্রামের পার্থক্যের কারণেও তাদের বৈষম্যের মাত্রা কোথাও কম কোথাও বেশি। সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, আর্থ-সামাজিক দিকবিবেচনায় তাদের জীবন ধারায় বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

যেখানে এক অঞ্চলের অবস্থার সাথে অন্য অঞ্চলের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর্র্থিক দিক বিবেচনায় তাদের গবেষণা অনুসারে সাভারের তুলনায় নাটোর, রাজশাহী, মানিকগঞ্জের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলক অনেক খারাপ, যেখানে সাভারে তারা স্বচ্ছ্বল ভাবে জীবন যাপন করছে সেখানে নাটোরে তাদের জীবনযুদ্ধে টিকে থাকায় দায়।

আবার একই ভাবে অঞ্চল ভেদে তাদের সামজিক ও ধর্মীয় বৈষম্যের মাত্রা ভিন্ন। যেমন সাভার, মানিকগঞ্জ বা রাজশাহীতে তারা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে পারলেও নাটোরের গুরুদাসপুর অঞ্চলে তা সম্ভব নয় এমনকি এই অঞ্চলে তাদের মৃত্যুর পরে লাশের জানাজা বা দাফন করতে দেওয়া হয়না বরং লাশকে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

তবে গবেষণায় সব অঞ্চলের একটি দিক থেকে মিল পাওয়া গিয়েছে তা হলো শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়া। এদের কেউই উচ্চ মাধ্যমিক এর গন্ডি পার হতে পারে নি। আর এর জন্য তারা দায়ী করে সহপাঠীদের তুচ্ছ্য-তাচ্ছুল্যতাকে এবং শিক্ষকদের অসহযোগিতাকে।

আরো একটা বিষয় স্পষ্ট যে এদের প্রতিটি অঞ্চলে গুরুমা রয়েছে, আর এদের দলের সবাই গুরুমার খুব অনুগত। তবে কখনো নিজের অনিচ্ছা সত্বেও এদের জীবনের ভয়ে গুরুমাদের প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করতে হয়। গুরুমারা বেশির ভাগই বিবাহিত।

কিন্তু এদের দলের কেউ বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাইলে সমাজ যেমন তাদের কাছে টেনে নেয় না, ঠিক তেমনি গুরুমারাও তাদের উপার্জন কমে যাওয়ার আশংকায় তাদের দল থেকে ছাড়তে চায় না। যেমন নাটোরের সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলেও গুরুমার অস্বীকৃতির কারণে তা আর সম্ভব হয়নি।

তবে একথা সত্য এদের উপার্জনের পথ সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা হওয়ায় অনেক স্বাভাবিক মানুষ নিজেকে তৃতীয় নিঙ্গের দাবি করে জড়িয়ে পড়ছে অপরাধ কর্মে, শুধু তাই নয় স্বাভাবিক বৈবাহিক জীবনের পাশাপাশি শুধু মাত্র অর্থের জন্য বিয়ে করছে এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে।

তবে মানিকগঞ্জ অঞ্চলের চিত্র ভিন্ন সেখানে অন্যকাউকে বিয়ে করলে তাদের ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তাই সেখানে তারা পতিতাবৃত্তিকেই বেছে নিয়েছে। তবে এটা অনুমেয় যে সমাজের এই অবহেলিত মানুষের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েই অনেক স্বাভাবিক মানুষ চাদা তোলা, এলাকা দখল করা থেকে শুরু করে একের পর এক অপরাধ কর্মে লিপ্ত হচ্ছে তারা। যা আমাদের প্রত্যাহিক জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।

তবে আমরা চাইলেও অস্বীকার করতে পারিনা যে, এই সম্প্রদায়কে প্রতিটি ধাপে যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। আর সমাজের এই নিষ্ঠুরতার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে অনেক সময় হয়ে উঠে আগ্রাসী। কিন্তু এইটা সত্য এরা মন থেকে যা একবার বিশ্বাস করে তার থেকে আর সরে আসে না বা বিশ্বাসঘাতকতা করে না। তাই আমরা চাইলেই কাজের সুযোগ দিয়ে তাদের স্বাভবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারি।

এই গবেষকদের মতে, শিক্ষা, সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, সামান্য ভালবাসা আর একটু সুন্দর কাজের সুযোগ বদলে দিতে পারে এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থার বর্তমান রূপ।