Home ঢাকা ক্যাম্পাস শিক্ষকদের ভাবনায় এবারের বাজেট

শিক্ষকদের ভাবনায় এবারের বাজেট


বাজেটের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি
অর্থমন্ত্রীর এবারের বাজেটের আকার বেড়েছে যা বিগত বাজেটের তুলনায় সাড়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বরাদ্দও বেড়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রবিশেষে। সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের জন্য বরাদ্দ অনেক বেড়েছে। এটা একটা ভালো দিক। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা সম্মানজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, এটা আর একটি ভালো দিক। কালোটাকা সাদা করার ব্যাপারে সরাসরি কিছু বলা হয়নি, আশা করি ভেতরে ভেতরেও কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দও বেড়েছে, তবে কীভাবে ব্যয় করা হবে তার পরিষ্কার ধারণা দেওয়া দরকার। তবে বাজেট দিলেই কর কমানো হোক কী বাড়ানো হোক জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এটা বন্ধ করা না গেলে যতই বলি ব্যবসাবান্ধব (এফবিসিসিআই) বা গরিবের বাজেট, সাধারণ মধ্যবিত্তের কোনো লাভ হবে না। বাজেটের আকার বাড়ছে বলে যতই গর্ব করি না কেন, প্রয়োগ যথাযথ না হলে সেসময়ের প্রেক্ষাপটে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের কয়েকশ কোটি টাকার বাজেট আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছয় লক্ষাধিক কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে কি? তবে এটা ঠিক, গত দশ বারো বছরে জীবনমানের যে উন্নতি ঘটেছে, করোনা প্রভাবে সেটা ধরে রাখা যেকোনো সরকারের জন্যই কঠিন।
——মাইনুল হাসান চৌধুরী
অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এবারের বাজেট বিশেষ গুরুত্ব বহন করে
নতুন অর্থবছরে (২০২১-২০২২) প্রস্তাবিত বাজেট নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এটি বাংলাদেশের ৫০তম বাজেট; দ্বিতীয়ত, এমন একসময়ে এই বাজেট ঘোষিত হলো যখন বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবী করোনার জীবনসংহারী আঘাতে বিপর্যস্ত; তৃতীয়ত, সম্প্রতি বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে কারেন্সি সোয়াপ বা
মুদ্রাবিনিময়ের আওতায় রিজার্ভ থেকে ২০ হাজার কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের বলিষ্ঠ প্রমাণ ও যৌক্তিকতা দেখিয়েছে। এসব বিবেচনা করলে এবারের বাজেট নিঃসন্দেহে একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

শিক্ষক হিসেবে আমার প্রত্যাশা ছিল, শিক্ষা খাতে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বরাদ্দ বেশি দেওয়া হবে। বরাদ্দ সামান্য বেড়েছে বটে তবে তা দিয়ে বড় কোনো সুফল আসবে বলে মনে হচ্ছে না। গতবার বরাদ্দ ছিল বাজেটের ১১.৬৯ শতাংশ; যা এবারে বেড়ে হয়েছে ১১.৯১ শতাংশ। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় যেখানে জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের ৬ শতাংশের অধিক বরাদ্দ রাখা হয় শিক্ষা খাতে, সেখানে এই বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে জিডিপির ২.০৮ শতাংশ, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এই টাকায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তো দূর কি বাত, আশপাশের দেশগুলোর শিক্ষার সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করা সম্ভব হবে না। তদুপরি এই বাজেটে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১৫ শতাংশ করারোপ করা হয়েছে অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী এগুলো ‘অলাভজনক’ প্রতিষ্ঠান। এই নতুন করারোপ শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি টিউশন ফির বোঝা চাপিয়ে দেবে। তবে এবারের বাজেটে করোনার কারণে ঝরে পড়া প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে উপবৃত্তি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক।
ড. মোহাম্মদ রোকন উদ্দীন
অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদালয়।

শিক্ষা খাতে বরাদ্দ যথেষ্ট নয়
এ বছর বাংলাদেশ সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে। ২০২১-এর বাজেট বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী মানে ৫০তম বাজেট। গত ৫০বছরে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব এগিয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশ আজ অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়ানোর সাহস দেখাচ্ছে। দেশের মানুষের আর্থসামাজিক বিবর্তন হয়েছে। একটি ধারণা আমাদের মধ্যে আছে, সমাজ যে পরিবর্তন হয়েছে এটা আপনা-আপনি হয়েছে। মূলত সরকারের নীতির বাইরে কিছুই হয় না। সরকার পলিসি নেয় বলেই সমাজ পরিবর্তন হয়।
কোভিড-১৯ সময়ে দেশে মোট গরিবের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি, যার শতকরা হার ২৯.৫ (বিআইডিএস)। তার মানে মহামারি যে কারো কারো জন্য আশীর্বাদ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এবারের বাজেটে এই ৫ কোটি মানুষের জন্য আলাদা করে তেমন কিছু নেই। কিন্তু দেশের শিল্পের প্রসার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি বৃদ্ধির জন্য করপোরেট কর কমানোসহ নানা প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। মহামারিতে তারা যে ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন, তা পুষিয়ে নিতে পারবেন। কৃষি ও সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়িয়েছে, তা এ বাজেটের ইতিবাচক দিক। বরাবরের মতো শিক্ষা খাত উপেক্ষিত থেকেছে। এ খাতে বাজেট হলো ৭২ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি, যা মূল বাজেটের ১২ ভাগ প্রায় আর জিডিপির দুই ভাগের চেয়ে একটু বেশি। শিক্ষা খাতে এত কম বাজেট রেখে কোনো দেশ শিক্ষায় উন্নতি করতে পারে না। জিডিপির ৪ ভাগের নিচে বাজেট রেখে শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়।
মুহাম্মদ মহিউদ্দীন
সহকারী অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাজেট সংকোচননীতি অনুসরণ করা হয়েছে
বাংলাদেশের করোনাকালীন দ্বিতীয় বাজেট সংকোচননীতি অনুসরণ করা হয়েছে। জীবন ও জীবিকা উন্নয়নে সর্বজনস্বীকৃত সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে প্রকৃত বরাদ্দ আগের চেয়ে কমেছে। এখনো পর্যন্ত জনপ্রশাসন খাত বাজেটের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার এবং নতুন দারিদ্র্যগ্রস্ত মানুষগুলোর জন্য আরো বেশি পরিমাণ বরাদ্দের দরকার।
তাছাড়া সামাজিক সুরক্ষার বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করা সরকারের জন্য বিশাল একটি চ্যালেঞ্জ। স্বাস্থ্য খাতের কাঠামোগত উন্নয়ন ও রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক দায়দায়িত্ব সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। অর্থনীতিকে পুনরায় গতিশীল করার উদ্দেশ্যে অধিকাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু টিকা নিয়ে অচলাবস্থার এখনো পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট সমাধান পাওয়া যায়নি। বিশাল ঘাটতি বাজেট অনুসরণ করার কারণে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ বাড়লেও করোনায় নাজেহাল শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া হবে, এটির ব্যাপারে কোনো স্পষ্টত পরিকল্পনা এই বাজেটে দেখা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে, করোনাকালীন মহামারি উত্তরণে স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, সামাজিক সুরক্ষা এবং গ্রামীণ ও কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারনির্ভর বাজেট প্রয়োজন। তাই গতানুগতিক বাজেট পরিহার করে যথার্থই মানুষ ও জীবিকার মান উন্নয়নের জন্য তৈরি হোক বাজেট। মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এটাই হোক জনগণের জন্য বিশাল প্রাপ্তি। এনামুল হক
সহকারী অধ্যাপক, ব্যাংকিং ও ইন্সুরেন্স বিভাগ, চবি।